৯২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্বকাপ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। বস্তুত এত বড় মাপের কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতাই হয়নি এই অঞ্চলে। মরুভূমির মধ্যে সবুজ গালিচা বানিয়েছে কাতার। বহু বিতর্ক মাথায় নিয়েই সাজিয়ে তুলেছে বাগান। কিন্তু ফুল ফোটাতে হবে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডোদের। তাঁরা দোহায় পৌঁছেছেন। সেইসঙ্গে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে আসা সমর্থকরা ইতিমধ্যেই প্রাণচঞ্চল করে তুলেছেন দোহার রাস্তাঘাট। ঘানার সমর্থকরা বর্ণময় পোশাকে নাচগান করছেন, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা মানুষদের বাজনা টেনে আনছে স্থানীয় মানুষকেও।
টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩০ লক্ষ। কাতারের আয়তন ছোট হওয়ায় সমর্থকদের থাকার জন্য হোটেলের বাইরেও ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রুইজ জাহাজ, মরুভূমির মধ্যে তাঁবু, নাগরিকদের বাড়ি। অনেকেই থাকছে বহুদূরে। এমনকি অন্য দেশেও। দোহা ও অন্যান্য মধ্য প্রাচ্যের শহরগুলির মধ্যে দিনে প্রায় ১০০ ফ্লাইট নতুন করে চালু করা হয়েছে। খেলা দেখে ফিরে যেতে পারবেন দর্শকরা। আকাশপথে এক ঘণ্টার দূরত্বে দুবাই তাই জমে উঠেছে দোহার মতোই।
রবিবার আয়োজক কাতার বনাম ইকুয়েদরের ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে প্রতিযোগিতা। উদ্বোধনী ম্যাচ এবং অনুষ্ঠান হবে আল বায়েত স্টেডিয়ামে। দোহার কেন্দ্র থেকে ৪০ কিমি দূরে আল খোরে সেই স্টেডিয়াম। ৬০ হাজার দর্শক খেলা দেখতে পারবেন। ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে। মোট আটটি স্টেডিয়ামে হবে খেলা। দুই স্টেডিয়ামের মধ্যে দূরত্ব সব থেকে বেশি হলে ৫৫ কিমি।
এমনিতেই আইন, সামাজিক বিধি, মানবাধিকার, বিশেষ করে অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণের মতো একাধিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছে। একদিকে বিতর্ক, অন্যদিকে ফুটবলকে ঘিরে উত্তেজনায় চড়চড়িয়ে বাড়ছে কাতারের তাপমাত্রার ফারেনহাইট। মূলত অত্যাধিক গরমের কারণেই নভেম্বর -ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা হয়েছে ২২তম বিশ্বকাপের আসর। নভেম্বরের এই সময় দোহার তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জুলাই মাসে তাপমাত্রা পৌঁছে ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বিশ্বকাপের সময়ে আর্দ্রতা থাকবে ৭১শতাংশ, যা স্টেডিয়ামের ভিতরে বেশি হবে। এই সমস্যা মোকাবিলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু মাথা চাড়া দিচ্ছে অন্যান্য সমস্যা। পোশাক বিতর্কের পর নতুন বিতর্ক টিকিটের দাম। আগের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে কাতার বিশ্বকাপের টিকিটের দাম। রাশিয়া বিশ্বকাপের থেকে গড়ে ৪০ শতাংশ বেশি এ বারের বিশ্বকাপ ফুটবলের টিকিটের দাম। ফাইনালের টিকিট কিনতে ফুটবলপ্রেমীদের ঘটি-বাটি বিক্রি করার উপক্রম। ফাইনালের টিকিটের দাম গড়ে ৬৮৪ পাউন্ড বা ৬৬ হাজার টাকার বেশি। ২০১৮ সালের ফাইনালের টিকিটের গড় দামের থেকে যা ৫৯ শতাংশ বেশি। রাশিয়া বিশ্বকাপে টিকিটের গড় দাম ছিল ২১৪ পাউন্ড বা প্রায় ২১ হাজার টাকা। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ২৮৬ পাউন্ড বা প্রায় ২৮ হাজার টাকা। গত ২০ বছরে কোনও বিশ্বকাপের টিকিটের গড় দাম এত বেশি ছিল না।
জল কিনতে গেলেও ভাল টাকা দিতে হবে দর্শকদের। ৫০০ মিলিলিটারের এক বোতল জলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০০ টাকা। রাত কাটাতেও খরচ করতে হচ্ছে ভালো রেস্তো। ফ্রি জোন ফ্যান ভিলেজ কেবিনের এক রাত্রি থাকতে গেলে খরচ প্রায় ২০৭ মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৬৮৭৫ টাকা। সস্তা বলতে কারাভান শহরে যে থাকার ব্যবস্থা আছে, সেখানকার একরাতের খরচ প্রায় ৯৩০০ টাকা।
মেসিরা মাঠে নামলে কে তাকাবেন অর্থনীতির দিকে? ৩২দলের এই বিশ্বকাপ মূলত তারুণ্যের। আর্জেন্টিনা দলেই আছেন এমন ১৯ জন যারা কোনোদিন বিশ্বকাপ খেলেনি। ব্রাজিলে রয়েছে ১৬ জন। ইকুয়েদরের ২৩জনই নতুন। ইউরোপের দলগুলিতেও সংখ্যা প্রায় তাই। তবে ইউরোপের ছায়া দীর্ঘতর। প্রতিযোগী দেশগুলির স্কোয়াড লিস্টে থাকা মোট ৮৩০ ফুটবলারের ৭৩ শতাংশই খেলেন ইউরোপে। ক্লাব ধরলে বার্সেলোনার ১৭ জন রয়েছেন বিভিন্ন দেশের স্কোয়াডে, বেয়ার্ন, ম্যাঞ্চেস্টার সিটির ১৬ জনকে করে। ‘দেশীয় শৈলী’ ক্রমশ জায়গা ছাড়ছে ইউরোপ-প্রাধান্যের ট্যাকটিকসকে।
দোহার রাস্তায় এখন গান ‘শুমিলাহ শুমিলাহ’। অফিসিয়াল গান নয়, কাতারে মুখে মুখে ফিরছে। বহু পুরানো এক আরাবিক শব্দবন্ধকে ব্যবহার করে বাঁধা হয়েছে এই গান। যেখানে ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এখন সেই স্বপ্নের নাম বিশ্বকাপ।
Comments :0