প্রতীম দে
সারিকার হাত কেটে গেলে রক্ত পড়ে। শরীরে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ওর শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৬.৫, স্বাভাবিকের চেয়ে কম। বয়স মাত্র ১৬। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী যা হওয়া উচিত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হওয়া উচিত ১১-১৪। একটি হোমে থাকে সারিকা। গোসাবার একটি হোমে।
সারিকা যখন জানতে পারে এই রোগের কথা তখন কিছুটা অবাক হয়েই বলে, ‘‘কোনদিন তো শুনিনি। আমার রক্ত কম। কই হাত কেটে গেলে তো রক্ত পড়ে।’’
জীবনে অনেক কঠিন লড়াই লড়েছে মেয়েটি। তখন লড়াই ছিল পরিবারের সাথে সমাজের সাথে। আর আজ লড়াই নিজের সাথে।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবার বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপর শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিলে টাকার জন্য পরিবারের লোকেরা তাকে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু লেখা পড়া করার স্বপ্ন ছোট বেলা থেকে দেখেছে সারিকা। পুলিশের সাহায্য নিয়ে কোনমতে নিজেকে বাঁচায়। প্রথমে ‘চাইল্ড লাইন’ ও পরে নরেন্দ্রপুরের ‘সংলাপ’ হোম হয় তার ঠিকানা।
এরপর মেয়েটি পড়াশোনা করতে চাওয়ায় চলতি বছর জানুয়ারিতে তাকে শিবগঞ্জের একটি হোমে পাঠানো হয়, আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত এখানে থেকে সে পড়াশোনা করবে।
শুধু সারিকা নয় বাসন্তী এবং গোসাবা ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত মহিলা রক্তাল্পতায় ভুগছেন। ঠিক। যেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে মায়েরা লক্ষ্মীর ভান্ডার পায়, সেই রাজ্যের দু’টি ব্লকে মহিলাদের স্বাস্থ্যের এই বেহাল দশা।
কোন সরকারি পরিসংখ্যানে এই তথ্য উঠে আসেনি। এই তথ্য উঠে এসেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজের মাধ্যমে। সংস্থার নাম ‘কেয়ার সুন্দরবন’। বিভিন্ন সময় এই প্রান্তিক এলাকার মানুষের জন্য এই সংস্থা কাজ করে থাকে। স্বাস্থ্য শিবিরের মতো নানা স্বেচ্ছামূলক কাজে নেমে হাতে উঠে এসেছে এই তথ্য।
বাসন্তী গোসাবা ব্লকে কি কোন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই? কোন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র নেই? যেখানে এই সব রোগের চিকিৎসা বা প্রসূতি মহিলাদের আয়রন টেবলেট দেওয়া হবে।
আছে। কিন্তু এখানে কোন কাজ হয় না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার নেই। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েতের দাবি এই ব্লকে মহিলাদের মধ্যে কোনও রক্তাল্পতার সমস্যা নেই। গোসাবা ব্লকের যেই পঞ্চায়েত এলাকায় এই সমস্যা প্রবল সেই রাঙাবেলিয়া পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দেব প্রসাদ সরকারের দাবি এই সমস্যা তাঁর জানা নেই।
উপপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘কী, রক্তাল্পতা? না না এই ধরনের কোন সমস্যা আমাদের এখানে নেই। আশা কর্মীরা নিয়মিত সব কিছু দেখে। তাঁদের কাছেও এই ধরনের কোন তথ্য নেই।’’ মাসে কতো আয়রন ট্যাবলেটের পাতা আশা কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়? উপপ্রধান বলেন, ‘‘ঠিক মনে নেই।’’
তবে দেব প্রসাদ সরকার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকের অভাবের কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার নেই। চিকিৎসার জন্য মানুষকে গোসাবা প্রাথমিক হাসপাতালে যেতে হয়। আর সেখানে না হলে কলকাতা।
তৃণমূল পরিচালিত রাঙাবেলিয়া পঞ্চায়েত প্রধান ভারতী মণ্ডল গায়েনের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করে হলে তিনি কোন উত্তর দেননি।
বাসন্তী, গোসাবা ব্লকের কোন মানুষ অসুস্থ হলে তাঁদের একমাত্র ভরসা গোসাবা প্রাথমিক হাসপাতাল। কিন্তু সেখানেও ঠিক ভাবে চিকিৎসা হয় না, এমনটা অভিযোগ করছেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা।
নমিতা গায়েন। গৃহ সহায়িকার কাজ করেন। বাড়ি গোসাবায় হলেও কলকাতায় ছোট ঘর ভাড়া করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘গোসাবায় কেউ অসুস্থ হলে তাকে ওই গোসাবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে, সেখানে তো কিছু হয় না। আর যদি বড় কিছু হয়, তাহলে হাসপাতাল থেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’’
গোসাবা, বাসন্তী ব্লক মিলিয়ে প্রায় আট লক্ষ মানুষ থাকেন। আর আট লক্ষের জন্য একটি মাত্র হাসপাতাল।
তাহলে কি অসুস্থ হলে সবাই হাসপাতালেই যান? না। প্রথমে তাঁরা ডাক্তারের কাছে যান। ৫০ টাকার ডাক্তার, কোয়াক ডাক্তার। ওষুধ দিতে দিতে ডাক্তার হয়েছেন তাঁরা। অসুখ গুরুতর চেহারা নিলে হাসপাতালে ছোটা ছাড়া গতি থাকে না।
‘কেয়ার সুন্দরবন’ সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা ভাস্কর পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘গত ৬ মে আমরা ৮০ জন মহিলার হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করি। সেখানে দেখা যায় যে অর্ধেকের বেশি রক্তাল্পতায় ভুগছেন।’’ তিনি জানাচ্ছেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গিয়েছে বহু এলাকায় মহিলাদের ৯৭ শতাংশ ভুগছেন রক্তাল্পতায়।
চিকিৎসকদের মতো অপুষ্টির জন্য এই ধরনের রোগ দেখা যায়। কিন্তু সঠিক সময় এর কোন চিকিৎসা না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করবে। সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তবে এই অঞ্চলে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র হোক বা হাসপাতাল কোথাও এই ধরনের পরীক্ষা করা হয় না, বলছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা।
Comments :0