এমনই জনস্রোত যে শেষ পর্যন্ত বাস ছেড়ে হেলিকপ্টারে উঠতে হলো মেসিদের। বিশ্বকাপজয়ীদের চোখের দেখা দেখতে বুয়েনস আয়ার্সে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। মেসিদের নিয়ে শোভাযাত্রার নির্ধারিত পথের চারপাশে লক্ষ লক্ষ মানুষে ভেঙে পড়েন। আবেগে-উন্মাদনায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে শোভাযাত্রা মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়। খেলোয়াড়রা উঠে যান হেলিকপ্টারে। সেখান থেকেই জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না। এমন দৃশ্য আর্জেন্টিনা তো বটেই, পৃথিবীতেই কখনো দেখা যায়নি।
৩৬ বছর পর বিশ্বজয়ের আনন্দে দেশের মানুষ দিশাহারা। আনন্দে উম্মত্ত জনগণ। সোসাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, আর্জেন্টিনার হুড খোলা বাসটি যখন বুয়েনস আয়ার্সের ব্রিজের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল কিছু মানুষ সেখান থেকেই বাসের উপর লাফানোর চেষ্টা করেছেন। কার্যত দুর্ঘটনার ঘটে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ভিক্টরি প্যারেড আট ঘণ্টা হওয়ার কথা ছিল, সমর্থকদের এমন বিশৃঙ্খল আচরণে তড়িঘড়ি সময় কমানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রশাসন। গোটা পথই অবরুদ্ধ। হুডখোলা বাসটি কিছু দূর যাওয়ার পরেই আটকে যায়। যে কারণে লিওনেল মেসিদের শোভাযাত্রা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছিল। ফুটবলারদের বাসের মধ্যে থেকেই হেলিকপ্টারে তুলে নেওয়া হয়। বাকি প্যারেডে হেলিকপ্টারে বসেই ফুটবলাররা সমর্থকদের অভিবাদন কুড়িয়েছেন। নিজেরাও অভিবাদন জানিয়েছেন। গান গেয়েছেন। সেলিব্রেশন করেছেন। আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফার্নান্ডেজের কথায়, ‘যেভাবে সারা দেশের মানুষ চ্যাম্পিয়ন দলকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছে এই অবিস্মরণীয় ডিসেম্বরে এই দৃশ্য হৃদয়ে চির অমর হয়ে থেকে যাবে।’ রাষ্ট্রপতির দপ্তরের মুখপাত্র গ্যাব্রিয়েলা চেরুতি জানিয়েছেন, ‘বাকি শোভাযাত্রায় ফুটবলাররা হেলিকপ্টারে ঘুরেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাস্তায় উপরে বাসের মধ্যে ফুটবলারদের রেখে শোভাযাত্রা চালানো সম্ভব ছিল না। উদ্যাপন হোক শান্তিতে। সুস্থভাবে ফুটবলারদের প্রতি ভালোবাসা ও প্রশংসা উজাড় করা যায়।’
আর্জেন্টিনার ফুটবল সভাপতি ক্লডিও তাপিয়া অবশ্য শোভাযাত্রা স্থগিত হওয়ার জন্য দায়ী করেছেন পুলিশকে। ট্যুইটারে লিখেছেন, ‘ওবেলিস্কের সামনে দাঁড়ানো মানুষদের অভিবাদন জানানোর সুযোগ দেওয়া হলো না। ওই নিরাপত্তা সংস্থাই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিল। খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’ বছর পঁয়ত্রিশের মার্তা অ্যাকোস্টা ভোর পাঁচটায় শহরে ছুটে এসেছিলেন, দক্ষিণ শহরতলি থেকে। শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যদের একবার দেখার জন্যে। কিন্তু শোভাযাত্রা সময়ের আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। মার্তা বলছেন, ‘আমি দুঃখিত। এত দূর থেকে চ্যাম্পিয়নদের দেখার সুযোগ পেলাম না।’ শুধু তাপিয়া নন, সাধারণ সমর্থকরাও পুলিশের উদ্দেশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পঁচিশের যুবক দিয়েগো বেনাভিদেজ ভীষণই ক্ষুব্ধ। দিয়েগোর কথায়, ‘আমাদের রাগ হচ্ছে। প্রশাসন গোটা ব্যাপারটাকে সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে পারলে আমরা সকলে আনন্দ করতে পারতাম। সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের থেকে প্রশাসন বিশ্বকাপ চুরি করে নিল।’ সাত বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শোভাযাত্রায় যোগ দিতে এসেছিলেন নিকোলাস লোপেজ। বলেছেন, ‘আমি হতাশ নই। শোভাযাত্রা উপভোগ করেছি।’
রবিবার থেকেই বুয়েনস আয়ার্সের রাস্তায় জনসমুদ্র। কাতারে কাতারে মানুষ এসে ভিড় করেছে এক জায়গায়। বুয়েনস আয়ার্সের ওবেলিস্ক মনুমেন্টের সামনে। যেখানে সব বয়সের মানুষেরা রয়েছেন। মেসিরা বিশ্বকাপ হাতে এজেইজা বিমানবন্দর নামলেন। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ভোর তিনটে বাজে তখন। বিমানবন্দরের বাইরে হাজারো হাজারোর মানুষের ভিড়। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের স্বাগত জানাবেন বলে। এমনিতেই বিশ্বজয়ের আনন্দে দেশের সরকার জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছিল। ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের শোভাযাত্রা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ৪০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল শোভাযাত্রায়। কেউ ছিলেন আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে। কেউ খালি গায়ে। সকলে কোরাসে গাইছেন ‘মুচাচাওস’। কিছু কিছু সমর্থকদের মুখে মারাদোনার নাম নিয়ে স্লোগান দিতে ব্যস্ত।
রোল্ডান নামের এক সমর্থক বলছেন, ‘আমরা মেসিকে দেখার জন্য মরতে অবধি পারি। মেসির মুখে স্মিত হাসি, আশায় ভরপুর উজ্জ্বল চোখ। আমার হৃদয়ে সুখে-আনন্দে ভরিয়ে দেয়। বিশ্বকাপ জয়ের দাবিদার বহুবছর থেকেই মেসি। ওই মুহূর্তটা ওঁর উদ্যাপন করার জন্যই।’ শেষবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতছিল ১৯৮৬’তে। ইয়েল তোরচিনিস্কির বয়স ছিল তিন বছর। বিশ্বজয়ের আনন্দ কী জিনিস, বোধগম্য হয়নি তাঁর। বলছেন, ‘তিন বছর বয়স ছিলাম। এখন কিছুই মনে নেই। এবার বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করব। আর্জেন্টিনার মানুষদের জন্য এই আনন্দের মুহূর্তটা দরকার ছিল।’
বুয়েনস আয়ার্স থেকে লিওনেল মেসি এদিনই যান তাঁর জন্মভূমি রোসারিওতে। সেখানে তাঁর বাড়ি রয়েছে। এক সময়ে এখানেরই ক্লাব নিউয়েলস ওল্ড বয়েজে খেলা শুরু করেছিলেন তিনি। রোসারিও বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে যান নিজের বাড়ি। গাড়ির চালকের আসনে ছিলেন স্ত্রী অ্যানাতোলা। দু’পাশে শত শত মানুষের ভিড় গানে, জয়ধডবনিতে তাঁকে স্বাগত জানান। ‘ ওহে চ্যাম্পিয়ন’ গানের সুরে ভেসে যায় রোসারিও।
Comments :0