দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে কর্ণাটকে সরকার বিজেপি’র। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজন তো বটেই। কর্ণাটকে জাতভিত্তিক বিভাজনও চালাচ্ছে বিজেপি সরকার। গণশক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাজ্যের পরিস্থিতি বিশদে ব্যাখ্যা করলেন সিপিআই(এম) কর্ণাটক রাজ্য সম্পাদক ইউ বাসবরাজ। একদিকে মানুষের জমি, মজুরি কাড়া হচ্ছে। আরেকদিকে আরএসএস’র পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে বিভাজনের। তার পালটা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াই প্রসঙ্গেও জানাচ্ছেন তিনি।
গণশক্তি: সরকারে বসে কর্ণাটকে কী ভূমিকা নিচ্ছে বিজেপি?
বাসবরাজ: বিজেপি এবং আরএসএস সুকৌশলে হিন্দুত্বকে সামনে রাখছে। আর একের পর এক সিদ্ধান্তে মেহনতি মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। কৃষকের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। রাজ্যে একদিকে ভূমি সংস্কার আইনে সংশোধনী পাশ হয়েছে। কৃষি জমি বেহাত যাতে না হয় আগে তার কিছু ব্যবস্থা ছিল। সেসব বাতিল করা হচ্ছে। আবার এই সরকারই গোহত্যা বন্ধে আইন পাশ করে সংখ্যালঘু বিরোধী প্রচার উসকে দিচ্ছে।
গণশক্তি: কৃষকের ওপর আক্রমণ কিভাবে হচ্ছে?
বাসবরাজ: রাজ্যে ভূমি সংস্কার আইনে কৃষককে সুরক্ষা দেওয়া ছিল। আইনে ঠিক করা ছিল চাষের জমি কিনতে হলে ক্রেতার আয়ের সীমা কত হবে। তা ছাড়া ইচ্ছে হলেই যে কোনও পরিমানে জমি কেনা যেত না। আইনের সংশোধনী পাশ করিয়ে সেই সুরক্ষা তুলে নেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট বা ধনী, যতটা ইচ্ছে জমি কিনতে পারবে এখন।
আরেকটি দিক হলো এপিএমসি আইন বা কৃষি উৎপাদন বিপণন সমিতি আইনের সংশোধন। কেন্দ্রের সরকার যেভাবে সরকারি মান্ডি বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চেয়েছে সেই অভিমুখেই হয়েছে সংশোধন। কৃষক সরকারি বাজারে ফসল বেচতে পারছেন না। ফড়ে বা কৃষি ব্যবসায়ীদের কাছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে কমে বিক্রি করতে হচ্ছে ফসল।
প্রজাস্বত্ত্ব আইনও বদলানো হয়েছে। এখানেও বাণিজ্যিক সংস্থাকে সহজে জমি তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে যাতে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আইনের বিধিনিষেধ এড়ানো যায়। একশ্রেণির প্রভাবশালী, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ, এরা আইনের পুরো সুযোগ নিয়ে জমি দখল করছে।
গণশক্তি: কর্ণাটক বারবারই শিরোনামে এসেছে বিদ্বেষের রাজনীতির কারণে। কিভাবে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণার রাজনীতি?
বাসবরাজ: সরকারের থেকে পুরোদমে ঘৃণা এবং বিদ্বেষের রাজনীতিতে মদত দেওয়া হচ্ছে। যেমন গোহত্যা বন্ধে আইনের নামে কার্যত সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ আইনের ক্ষেত্রে প্রচার হলো জোর করে ধর্ম বদলে দেওয়া হচ্ছে। কেবল তাই নয়। সরকারি বরাদ্দ বিনিময়েও রাখঢাক না করে বিভেদ হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিহত মুসলিম হলে পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। হিন্দু হলে দেওয়া হচ্ছে।
মনে করার কারণ নেই যে কেবল ধর্মীয় বিভাজন হচ্ছে। জাতপাতেরও বিভাজন হচ্ছে। উচ্চবর্ণের জন্য পক্ষপাত চাপা ঢাকা দেওয়ার বিষয়ই নেই। সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। যে সংবাদগোষ্ঠীর প্রধান ব্রাহ্মণ তাদের মাসে দু’বার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। জাতিভেদ করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। মনে করবেন না বিজেপি সরকার কেবল ধর্মীয় বিভাজনের রাস্তায় চলছে। উচ্চবর্ণের পক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট।
গণশক্তি: কর্ণাটক সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য ,শিল্প, নাট্যকলা তো বটেই চিন্তার জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সেখানে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান স্লোগানে বলীয়ান বিজেপি বারবার জমি কিভাবে পাচ্ছে। নির্বাচনে জয়ী হচ্ছে, সামাজিক বিচারেও প্রভাবশালী হচ্ছে। কেন?
বাসবরাজ: প্রথম কথা এবার সরকার কিন্তু নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে চালাচ্ছে না। পাঁচ বছর আগে একক গরিষ্ঠ দল হলেও সরকার চালানোর মতো গরিষ্ঠতা ছিল না। কংগ্রেস ভাঙিয়ে বিধায়ক জোগার করেছে। তবে তার আগে বিএস ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে ভোটে জিতে সরকার বিজেপি গড়েছিল।
দ্বিতীয় কেবল সরকার নয়, সাংগঠনিক বিচারেও আরএসএস-বিজেপি লাগাতার বিভাজনের আদর্শ প্রচার করে যাচ্ছে। শ্রীরঙ্গপত্তনমে টিপু সুলতানের রাজধানী ছিল। সেখানেই বিখ্যাত মসজিদ রয়েছে। প্রচার হচ্ছে, হনুমান মন্দির ভেঙে এই মসজিদ করেছিলেন টিপু। অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এদের শক্তি বেড়েছে। রামমন্দির তৈরির প্রচার জোরালো হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্ণাটকে বাড়ছে হনুমান মন্দিরের প্রচার।
রাজ্যের উত্তর অংশে হাম্পি, বিজয়নগর জেলায়। সেখানে অঞ্জনাদ্রির মন্দির রয়েছে। হনুমানের জন্ম এখানেই, এই মর্মে কেবল প্রচার হচ্ছে না, হনুমান মন্দিরের জন্য হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক নামানো হয়েছে, অর্থ সংগ্রহ হচ্ছে। এখানে পুজো নয়, আসলে রাজনৈতিক প্রচার হচ্ছে। সরকার প্রচার করতে অঞ্জনাদ্রি মন্দির থেকে অযোধ্যা সরাসরি যোগাযোগের জন্য সড়ক পথে, আকাশ পথে সংযোগ তৈরি করা হবে। এভাবে পুরানকে ইতিহাস বলে একটি বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। আরএসএস পাহাড়ে রামায়ন মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলেছে।
গণশক্তি: ধর্মীয় অন্ধতার প্রচার, তাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচন। এই কৌশলের প্রতিরোধ কর্ণাটকে কিভাবে হচ্ছে?
বাসবরাজ: কর্ণাটকেই খুন করা হয়েছে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে, অধ্যাপক এমএম কালবুর্গিকে। তার আগে নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারিকে খুন করা হয়েছে। প্রত্যেকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধী, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্মনিরপেক্ষতার সোচ্চার মুখ ছিলেন। হত্যার পর প্রতিবাদও হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়।
সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা চাইছে এমন শক্তিগুলিকে একজোট করতে। প্রগতিশীল লেখক সংগঠন, ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মীয় প্রচারকদেরও একত্রে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে। মুখ্য প্রশ্ন সামনে রাখা হচ্ছে যে দেশের সংবিধান রক্ষা করা যাবে কিনা। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে কিনা।
গণশক্তি: নির্বাচন রয়েছে কয়েকমাসের মধ্যে। কিভাবে এগনোর কথা ভাবছে সিপিআই(এম)?
বাসবরাজ: কর্ণাটকে লড়াইয়ে একইসঙ্গে আক্রমণের মুখে রাখতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িক এবং জাতভিত্তিক রাজনীতির শক্তিকে। দু’টি ভূমিকাই নিচ্ছে বিজেপি এবং আরএসএস। দলিতদের মধ্যে অস্পৃশ্যদের বিভিন্ন অংশ অধিকারের দাবিতে বাড়তি সক্রিয় হয়েছে। ভয়াবহ সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই অংশের।
সরকার উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ করেছে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশ বা ইডব্লিউএস কোটার মাধ্যমে। সেখানে ভাগ করা হয়েছে ব্রাহ্মণদের ৩ শতাংশ, ভোক্কালিগা ৪ শতাংশ, লিঙ্গায়তদের ৩ শতাংশ।
কংগ্রেসও প্রচারে নেমেছে। সরকার গড়তে পারলে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে, ২ হাজার টাকা করে মহিলাদের ভাতা দেওয়ার কথা বলছে। নতুন পেনশন প্রকল্পের বিরোধী সরকারি কর্মীরা। কংগ্রেস বলছে সরকারে ফিরলে পুরনো পেনশন প্রকল্প চালু করবে। তা নিয়ে যদিও কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা রয়েছে। কারণ এখন বিরোধী দলনেতা সিদ্ধারামাইয়া মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে এই দাবি মানেননি। এর মধ্যে জেডি(এস)-ও প্রচার নেমেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী নিজেই বলছেন, নির্বাচনে কেউ গরিষ্ঠতা পাবে না।
গণশক্তি: বামপন্থীরা কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
বাসবরাজ: এখনও পর্যন্ত ৭টি আসন চিহ্নিত হয়েছে যেখানে বামপন্থীরা প্রার্থী দেওয়ার অবস্থায়। সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই-এমএল লিবারেশন, এসইউসিআই, ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে আরপিআই’র আম্বেদকর গোষ্ঠী, সর্বোদয় কর্ণাটক এক জায়গায় এসেছে। জনতা দল (এস)’র সঙ্গেও আলোচনা চলছে। একটি সাম্প্রদায়িক, জাতভিত্তিক বিভাজনে রাজ্যকে ধ্বংস করছে বিজেপি এবং আরএসএস। রাজ্যের সরকার থেকে এই শক্তিকে হটাতে সব চেষ্টা করবে সিপিআই(এম)।
(ছবি: মনোজ আচার্য)
Comments :0