দীর্ঘ টালবাহানার পরে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে গ্রেপ্তার শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল। সিবিআই-র হাতে গ্রেপ্তার টাকার বিনিময়ে চাকরির দুর্নীতির আরও এক এজেন্ট নীলাদ্রি ঘোষ।
এই নিয়ে গত তিনদিনে নিয়োগ দুর্নীতিতে ৮জনকে গ্রেপ্তার করল সিবিআই। কলকাতা হাইকোর্টে ভর্ৎসনার পরেই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই তৎপরতা। ধৃতদের প্রত্যেকেই নিয়োগকাণ্ডে টাকা তোলা, চাকরি প্রার্থী জোগাড় করার অপারেশনে মূলত এজেন্ট হিসাবে কাজ করতো।
শুক্রবার এই নিয়োগ দুর্নীতিতেই বাগদার সেই ‘সৎ রঞ্জন’ ওরফে চন্দন মণ্ডল সহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। ধৃতদের মধ্যে সিংহভাগই শাসক দলের শুধু ছত্রছায়ায় ছিল তা নয়, আরামবাগের শাহীদ ইমাম থেকে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার কৌশিক ঘোষ রীতিমত দাপুটে তৃণমূল নেতা হিসাবেই নিয়োগ দুর্নীতির এজেন্ট চক্রে শামিল হলো।
একদিনের ব্যবধানের পরে রবিবার ফের দু’জনকে গ্রেপ্তার করল সিবিআই। এদিনই দুপুরে তাপস মণ্ডল, নীলাদ্রি ঘোষ সহ এই দুর্নীতিতে যুক্ত ছয়জন এজেন্টকে নিজাম প্যালেসে তলব করেছিল সিবিআই। প্রায় তিন ঘণ্টা লাগাতার জেরার পরে বিকাল পাঁচটা নাগাদ অবশেষে তাপস মণ্ডল ও নীলাদ্রি ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ধৃতদের মধ্যে অন্যতম চরিত্র হলো এই তাপস মণ্ডল। গত কয়েক মাসে ইডি-সিবিআই মিলে অন্তত দশবারের বেশি জেরায় হাজির হয়েছিলেন এই শিক্ষা ব্যবসায়ী। এর আগে সাংবাদিকদের সামনে এই তাপস মণ্ডলই প্রথম নিয়োগকাণ্ডে যুক্ত যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষের নাম জানিয়ে দেন। কুন্তল ঘোষ যে প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিকে বিপুল টাকা তুলেছিল সাংবাদিকদের সামনে তাও জানান। নিজাম প্যালেসে সিবিআই দপ্তরে হাজিরা দিতে এসে কিছুদিন আগেই এই তাপস মণ্ডলই সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন, ‘আমার কিছু পরিচিত ছাত্র-ছাত্রী একজনকে টাকা দেয় চাকরির জন্য। সেই নামটি আমি ইডিকেও বলেছিলাম। তার নাম কুন্তল ঘোষ। আমার হিসেব অনুযায়ী ১৯ কোটি ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজারের মতো টাকা তুলেছিল। প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক মিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার খেলা।’ সিবিআই-কে একাধিক তথ্যও দিয়েছিলেন। এদিন সিবিআই লাগাতার জেরার পরে তাকে গ্রেপ্তার করে।
তবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকরা মনে করছেন, তাপস মণ্ডল অনেক তথ্য লুকানোর চেষ্টা করছে। বড় কোনও প্রভাবশালীকে আড়ালের চেষ্টা করছেন। এর আগে অনেক তথ্য তদন্তকারীদের জানালেও আরও গুরুত্বপুর্ণ অনেক তথ্য পরিকল্পিতভাবে চেপে যাচ্ছেন, তদন্তকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। তাই তাঁকে হেপাজতে নিয়ে জেরা করতে চাইছে সিবিআই।
কে এই তাপস মণ্ডল? গত ৭ ডিসেম্বর নিয়োগকাণ্ডে অতিরিক্ত চার্জশিট দায়ের করেছিল ইডি। সেখানে মানিক ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী, পুত্রের পাশাপাশি তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এই শিক্ষা ব্যবসায়ীর নামও ছিল। অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স সংস্থার নামও বারেবারে আসে এই নিয়োগ দুর্নীতিতে। এই সংস্থা মূলত শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে। আগে এর সভাপতি ছিলেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা নলহাটি-২নম্বর ব্লকের সভাপতি বিভাস অধিকারি। পরবর্তীতে মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ হিসাবে তাপস মণ্ডলকে সভাপতি পদে বসানো হয়।
গোটা রাজ্যে তাঁর বিএড, ডিএলএড সহ প্রায় কুড়িটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মহিষবাথানে ‘মিনার্ভা এডুকেশনাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থাও চালান তাপস মণ্ডল। এর আগে তাপস মণ্ডল জানিয়েছিলেন মহিষবাথানে তাঁর অফিস থেকে মানিক ভট্টাচার্যকে ছাত্র পিছু টাকা পাঠানো হত নিয়ম করেই। মানিক ভট্টাচার্যকে তাঁর কলেজের ছাত্র পিছু টাকা পাঠাতে হতো নগদে, সেকথাও সাংবাদিকদের সামনেই জানিয়েছিলেন এই ব্যক্তি। এই তাপস মণ্ডলের সঙ্গেই শিক্ষা ব্যবসায় হাত পাকিয়েছিল কুন্তল ঘোষ। তাপস মণ্ডলের সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়েও এর আগে জেরা করা হয়েছিল ধৃত কুন্তল ঘোষকে।
দু’দশক আগে পুর্ব মেদিনীপুর থেকে এসে বারাসতের দেবীপুরের একটি টিনের চালাঘরে থাকতে শুরু করেন তাপস মণ্ডল। ২০১১ সালের পর এই বাড়ির অদূরেই জমি কিনে আরেকটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেন তিনি। সিবিআই-এর পাশাপাশি ইডি’র আধিকারিকরাও গত অক্টোবরে হানা এই ডেরায়।
গত দু’বছরে মানিক ভট্টাচার্যের অন্যতম সহযোগী এই তাপস কুমার মণ্ডল। প্রাথমিকে নিয়োগের মেরিট লিস্ট, টাকার দেওয়া প্রার্থীদের নামের তালিকা শেষদিকে এই ব্যক্তি সরাসরি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পাঠাতেন বলে। সেই সূত্রে নিয়োগকাণ্ডে ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। মানিক ভট্টাচার্যের অন্যতম শাগরেদ এই তাপস মণ্ডলের মহিষবাথানে ‘মিনার্ভা এডুকেশনাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থার অফিস থেকেই একাধিক অযোগ্য প্রার্থীদের টাকার বিনিময়ে নিয়োগের নিশ্চয়তা দেওয়া হত। মূলত প্রাথমিকে নিয়োগের চক্র চলেছিল এই অফিস থেকেই বলে মনে করছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা।
এদিন বিকালে গ্রেপ্তারির পরে এসএসকেএম হাসপাতালে মেডিক্যাল টেস্টের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় যদিও সাংবাদিকদের সামনে তাপস মণ্ডল বলেন, ‘তদন্তে সহযোগিতা করছি, সবসময় করব। আমি এখনও মনে করি আমি নির্দোষ, তদন্তে সহযোগিতা করছি’।
তাপস মণ্ডলেরই সহযোগী নীলাদ্রি ঘোষ। গড়িয়ার বাসিন্দা। ইডি’র হাতে গ্রেপ্তারির পরে ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ পালটা অভিযোগ এনে সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন তাপস মণ্ডলেরই লোক নীলাদ্রি ঘোষ। গড়িয়ার বাসিন্দা ঐ ব্যক্তি ইডি-সিবিআই ম্যানেজ করার নামে টাকা নিয়েছিল আমার কাছ থেকে।
সে সময় যদিও তাপস মণ্ডল জানিয়েছিলেন, ‘নীলাদ্রি আমার কাছে আসত। আমার পরিচিত ছিল। আর কুন্তলের কাছে টাকা তো চাইবই। টাকা ওকে দেওয়া হয়েছে, সেই টাকা চাইব না! ও যে চাকরিপ্রার্থীদের থেকে টাকা নিয়েছে, সেই টাকাই ফেরত চাওয়া হয়েছিল’। চাকরি করিয়ে দেওয়ার নামে নীলাদ্রি ঘোষও একাধিকজনের কাছ থেকে টাকা তুলেছিল।
Comments :0