Strike 9 July

ধর্মঘটে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের লড়াই

উত্তর সম্পাদকীয়​

অরূপ চ্যাটার্জি
আগামী ৯ জুলাই, ২০২৫ তারিখে ভারতের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফেডারেশনগুলি দেশের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে, কিছু নির্দিষ্ট দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
১৯৯১ সালে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি, যা সাধারণত LPG (liberalisation, privatisation and globalisation) নী‍‌তি নামে পরিচিত, প্রবর্তনের পর থেকে ট্রেড ইউনিয়নগুলি ধারাবাহিকভাবে এই নীতির বিরোধিতা করছে এবং শ্রমিক কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের উপর এর কু-প্রভাবের বিরোধিতা করে আসছে। এখন পর্যন্ত ২৩টি সর্বভারতীয় ধর্মঘট পালিত হয়েছে এবং আগামী ৯ জুলাই, ২০২৫ ২৪ তম ধর্মঘট হতে চলেছে। প্রতিটি ধর্মঘটই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বর্তমান ধর্মঘটটিও তার প্রধান দাবিগুলির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের শীর্ষ সংগঠন কনফেডারেশন নির্দিষ্ট দাবিসনদ নিয়ে ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কনফেডারেশনের সহযোগী সংগঠনগুলি ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধর্মঘটের নোটিস দিয়েছে।
এখন মূল প্রশ্ন হলো, ‘‘ কেন কেন্দ্রীয় সরকারি শ্রমিক কর্মচারীরা ধর্মঘটে যাচ্ছে’’ । এবার ধর্মঘটের শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রধান দাবি হলো ‘৪টি শ্রমকোড অবিলম্বে বাতিল করতে হবে’। শ্রমকোড প্রবর্তন মোদী সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত। ‘শ্রম আইন সংস্কার’-এর নামে শ্রমিক কর্মচারীদের বহু লড়াই সংগ্রাম করে পাওয়া ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রম কোডে পরিণত করা হয়ে‌ছে। যা করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার তাগিদে। এই সরকার প্রতিনিয়ত যেমন কর্পোরেটদের বন্ধু হিসাবে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, অপরপক্ষে শ্রমিক কর্মচারীদের স্বার্থে আঘাত করছে। কর্পোরেটদের সুবিধা দেওয়ার জন্য এটি LPG প্রক্রিয়ার একটি আক্রমণাত্মক রূপ। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকার শ্রম কোডগুলিকে প্রয়োগ করতে সফল হলে, শ্রম আইনের প্রদত্ত ন্যূনতম সুরক্ষা বিলোপ হবে। নিয়োগকর্তাদের দ্বারা কাজের সময় ৮ ঘণ্টার বেশি করা হবে এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে শ্রম-দাসত্ব বৃদ্ধি পাবে। তাই সরকারের পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা এবং প্রতিরোধ করা ছাড়া শ্রমিকশ্রেণির আর কোনও বিকল্প নেই।
‘‘সমান কাজের জন্য সমান বেতন’’ দাবিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুপ্রিম  কোর্ট অনেক আগেই এই বিষয়ে রায় দিয়েছে কিন্তু সরকার এখনও তা বাস্তবায়ন করেনি। স্থায়ী কাজ চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের দিয়ে করানো হচ্ছে এবং একজন নিয়মিত শ্রমিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের বেতনের বৈষম্য বিচার বিভাগের রায়ের যথার্থতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
এছাড়াও, ‘‘অসংগঠিত শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে’’, ‘‘সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেটাইজেশন বন্ধ করতে হবে’’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলি হলো মৌলিক দাবি যা শ্রমিক কর্মচারীরা ক্রমান্বয়ে দাবি করে চলেছে। কিন্তু সরকার কোনও কর্ণপাত করেনি। কনফেডারেশন তাদের নিজস্ব ৭ দফা দাবি-সনদ জমা দিয়েছে যা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের সকল স্তরের এমনকি পেনশনভোগীদের জন্যও প্রযোজ্য।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো — ‘‘৮ম বেতন কমিশন গঠন করতে হবে’’ — সরকার ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ৮ম বেতন কমিশন ঘোষণা করেছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত তার শর্তাবলী সহ কোর কমিটি গঠন করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন এবং ভাতা, পেনশনভোগীদের সাথে, ১ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখ থেকে সংশোধন করা হয়েছিল। বেতন কমিশন গঠনের বিলম্বের ফলে বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর হতে বিলম্ব হবে। JCM নেতৃত্ব সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করে বিষয়টি তুলে ধরেছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কোনও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
‘‘NPS/UPS বাতিল করে সকল কর্মচারীর জন্য OPS চালু করতে হবে’’ — NPS এবং UPS উভয়‌ই contributory স্কিম। NPS-এ সঞ্চিত অর্থের 40% কোনও পর্যায়ে ফেরত দেওয়া হয় না এবং UPS-এ সঞ্চিত অর্থ বা ইন্ডিভিজুয়াল করপাস কোনও পর্যায়ে ফেরত দেওয়া হয় না, কেবলমাত্র ও মানের যোগ্যতা সম্পন্ন পরিষেবার জন্য অবসরকালীন সময়ে এককালীন অর্থ প্রদান করা হয়। কেবলমাত্র OPS হলো সর্বোত্তম পেনশন স্কিম যা ডিফাইন্ড বেনিফিট স্কিম। তাই, ১/১/২০০৪ তারিখের পরে নিয়োগপ্রাপ্তি কর্মীদের জন্য OPS পেনশন টিম চালু করার দাবি করা হচ্ছে।
‘‘কোভিড সময়কালে ৩ কিস্তি DA/DR আটকে রাখা হয়েছে। কোভিডের কারণে স্থগিত রেখেছিল মহামারী পরিস্থিতির কারণে। কর্মচারীরা ক্রমাগত অনুরোধ করা সত্ত্বেও সরকার ৩ কিস্তি DA/DR ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করছে।
‘‘১৫ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর পর পেনশনের কমিউটেড অংশ ফিরিয়ে দিতে হবে। ৫ম বেতন কমিশন গভীর গবেষণার পর ১২ বছরের কমিউটেড অংশ পুনরুদ্ধারের সুপারিশ করেছে। তৎকালীন প্যারামিটারের উপর ভিত্তি করে ১৯৮৬ সালে ১৫ বছর পর কমিউটেড অংশ পুনরুদ্ধারের নিয়ম তৈরি করা হয়েছিল। সুদের হার, আ‌য়ুষ্কাল, মৃত্যুহার/মৃত্যুর হার, ঝুঁকির কারণ ইত্যাদির মতো বর্তমান প্যারামিটারগুলি ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। তাই ১৫ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর পর কমিউটেড অংশ পুনরুদ্ধারের দাবি করা হচ্ছে।
‘‘কম্প্যাশনেট নিয়োগের উপর ৫% সীমা তুলে নিতে হবে এবং মৃত কর্মচারীদের পোষ্যদের জন্য কম্প্যাশনেট নিয়োগ করতে হবে’’ এ‍‌ই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো চাকরিতে মারা যাওয়া সরকারি কর্মচারীর পরিবারকে তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদান করা এবং নির্ভরশীলকে চাকরি প্রদান করা পরিবারকে হতাশ না করে। সুপ্রিম কোর্টের অনেক অনুকূল রায় রয়েছে। এই ৫% সর্বোচ্চ সীমা শুধুমাত্র রেলওয়ে ব্যতীত কেন্দ্রীয় সরকারি বিভাগগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই এই সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে।
‘‘সকল বিভাগ/মন্ত্রণালয়ের সকল ক্যাডারের শূন্য পদ পূরণ করতে হবে, আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে।’’ ভারতের জনসংখ্যা বছরের পর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলিতে শূন্য পদ পূরণ না করার কারণে প্রতি বছর কর্মী সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ভারতে জনসংখ্যার মাত্র ১% কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ১০ লক্ষ পদ খালি রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ৪টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১টি পদ খালি রয়েছে। তাই ৬ মাসের মধ্যে বিশেষ নিয়োগ অভিযানের মাধ্যমে সমস্ত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সমস্ত শূন্যপদ পূরণ করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি, স্থায়ী প্রকৃতির চাকরি আউটসোর্স করা চলবে না।
অ্যাসোসিয়েশন/ইউনিয়ন/ফেডারেশনগুলির গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যে সকল অ্যাসোসিয়েশন/ইউনিয়ন/ফেডারেশনগুলির স্বীকৃতি বিচারাধীন তাদেরকে অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে, AIPEU-GR.-C ইউনিয়‌ন, NFPE এবং ISROSA’র স্বীকৃতি বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করতে হবে, জাতীয় পরিষদ/বিভাগীয় পরিষদ/ আঞ্চলিক পরিষদের সভা নিয়মিত সময় অন্তর অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং সিদ্ধান্তের ফলাফল অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা উচিত।
‘‘ক্যাজুয়াল, কন্টিনজেন্ট, চুক্তিভিত্তিক কর্মী এবং GDS (গ্রামীণ ডাক সেবক) কর্মচারীদের নিয়মিতকরণ করতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত (Autonomous) সংস্থার কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় সরকারের সমান মর্যাদা দিতে হবে’’ । বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভাগগুলিতে ২২% অস্থায়ী কর্মী/কন্টিনজেন্ট/দিন মজুর কর্মী কোনও কর্মসংস্থানের সুরক্ষা ছাড়াই কাজ করছেন। ওইসব কর্মীদের বিভাগীয় পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ডাক বিভাগের পূর্বেকার অতিরিক্ত বিভাগীয় (ইডি) কর্মীদের নামকরণ করা হয়েছে গ্রামীণ ডাক সেবক । তাঁরা নি‌য়মিত ডাক কর্মীদের মতোই মৌলিক কাজের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা ডাক বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁদের নিয়মিত করতে হবে এবং তাঁদের বেতন কাঠামো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সমহারে করতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সমান মর্যাদা প্রদান করতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment