গোরু পাচার কাণ্ডের চার্জশিটে যাদের নাম রয়েছে বা যারা জেরার মুখে পড়েছেন কেবল তারাই নির্দিষ্ট একটি লটারি সংস্থার বিপুল টাকার পুরস্কার মূল্য ‘জিতছেন’ কী করে? অনুব্রত মণ্ডলকে নিয়ে ইডি’র তৎপরতার মাঝেই লটারি কেলেঙ্কারিতে ফের নতুন তথ্য জানালো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
গোরু পাচার কাণ্ডে দুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতেই ধৃত অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর মেয়ে মোট পাঁচ দফায় নির্দিষ্ট একটি লটারি সংস্থার খেলায় ‘বিজেতা’ হয়ে দু’কোটি টাকার বেশি পেয়েছিলেন। এবার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে সামনে এলো গোরু পাচারের কিংপিন এনামূল হকের ৫০ লক্ষ টাকা লটারি জেতার কাহিনি! ২০১৭ সালে গোরু পাচার কাণ্ডের এই মাথা বেমালুম ওই নির্দিষ্ট সংস্থার লটারি টিকিট কেটে ৫০ লক্ষ টাকা জিতেছিলেন! ঠিক সেই সময়েই গোরু পাচারের কারবারের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয় এনামুল হকের। মুর্শিবাদের আটটি থানা এলাকায় তখন গোরু পাচারের রমরমা। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ এনামুল হককে ততদিনে ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে তৃণমুলের হয়ে কাজ করতেও দেখা গিয়েছে।
সিবিআই সূত্রের দাবি, এনামুল হকের স্ত্রী, ভাই এবং পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যও রহস্যজনকভাবে লটারির বিপুল টাকা পেয়েছিলেন। সিবিআই আধিকারিকদের কথায়, ‘‘গোরু পাচারের কিংপিন থেকে অনুব্রত সকলেই একটি লটারি সংস্থার টিকিটে কোটি কোটি টাকা জিতছেন! এটা এত সাধারণ ঘটনা নয়। গোরু পাচার কাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কালো টাকা সাদা করার কৌশল।’’ মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তের অংশ হিসাবেই লটারি কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু করেছে ইডি’ও। গোরু ও কয়লা পাচারের বিপুল কালো টাকা সাদা করার কৌশলের সঙ্গেই সম্পর্কিত এই লটারি কেলেঙ্কারি। গোটা রাজ্যেই গত কয়েক বছরে কোটি কোটি কালো টাকা ওই লটারির মাধ্যমে সাদা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই লটারি সংস্থার শীর্ষকর্তাদের তলবও করেছে ইডি। সাত বছর আগে ওই লটারি সংস্থার কলকাতার অফিসেই আয়কর দপ্তর তল্লাশি চালিয়ে ৭০ কোটি টাকা নগদ বাজেয়াপ্ত করেছিল। ২০১৬’র তৃণমূল দ্বিতীয়বার সরকারের আসার পর থেকে এই সংস্থার রমরমা বাড়ে। চেন্নাই থেকেই মূলত চলে এই সংস্থার কারবার।
এদিকে, বৃহস্পতিবার আদালত থেকে অনুমতি নিয়েই আসানসোল সংশোধনাগারে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অনুব্রত মণ্ডলকে জেরা করার পরে ‘অ্যারেস্ট’ করে ইডি। সিবিআই গত ১১আগস্ট অনুব্রতকে তাঁর বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারপর ১৪ দিন সিবিআই হেপাজতে নিজাম প্যালেসে থাকার পরে অনুব্রত মণ্ডলের ঠিকানা হয় আসানসোল সংশোধনাগার। ফলে অ্যারেস্ট করলেও ইডি নিজেদের হেপাজতে পায়নি। যদিও অনুব্রতকে নিজেদের হেপাজতে দিল্লির সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে জেরা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি।
শুক্রবারই দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে অনুব্রতর বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারির আবেদন জানালো ইডি। তদন্তকারী সংস্থার তরফে আইনজীবী নীতেশ রানা আদালতে জানায়, তদন্তে এই পর্বে অনুব্রতর বিরুদ্ধে নতুন তথ্য মিলেছে। দিল্লির সদর দপ্তরে গোরু পাচারে একাধিক জনকে জেরা করেই সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসে। তাই অনুব্রতকে দিল্লিতে নিয়ে এসে জেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করার আবেদন জানানো হয়। ইডি’র সাবমিশন দেখার পরে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টের বিশেষ বিচারক রঘুবীর সিংহ আগামী ২২ নভেম্বর, মঙ্গলবার শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
মঙ্গলবার যদি প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুর আবেদন মঞ্জুর হয়, তবে সেদিন রাতেই অথবা বুধবার অনুব্রতকে দিল্লিতে নিয়ে এসে জেরা করতে চাইছে ইডি। লটারি কাণ্ডের পাশাপাশি তাঁর কন্যা সুকন্যা, হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারি ও দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের বয়ানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা কথিত ‘বীর’ অনুব্রতর মাথায় ‘অক্সিজেনের অভাব’ আরও বাড়াতে পারে! গোরু পাচার মামলায় গত ৪ নভেম্বর সায়গল হোসেনের তিহার জেলযাত্রা অনুব্রতর চাপ আরও বাড়িয়েছে। একই মামলায় এবার কী তবে অনুব্রতরও কী গন্তব্য হতে চলেছে সেই তিহাড় জেল?
গোরু পাচার কাণ্ডে ইতিমধ্যে সিবিআই’র চার্জশিটে সায়গল হোসেনের মতো অনুব্রতকেও অভিযুক্ত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুব্রতর হয়েই এনামুলের সঙ্গে গোরু পাচারের কারবারে সমন্বয় রাখা, টাকা লেনদেন করতো এই দেহরক্ষী সায়গলই। গত ৯ জুন সায়গলকে নিজাম প্যালেসে দীর্ঘ জেরা শেষে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। তদন্তকারী সংস্থার হেপাজতের মেয়াদ শেষে আসানসোল জেলেই ছিলেন সায়গল। এই পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে গোরু পাচারের পথ সুগম করে দেওয়ার শর্তে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলার অভিযোগ ছিল। তার একাধিক বাড়ি, টাকার পরিমাণ, বিপুল সম্পত্তি দেখে তাজ্জব গোয়েন্দা আধিকারিকরাও। একজন সরকারি দেহরক্ষীর এই পরিমাণ অর্থ,সম্পত্তি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তি! অনুব্রতর হয়ে সীমান্তে গোরু পাচার কারবার দেখতো এই দেহরক্ষী। গোরু পাচারের কিংপিন এনামুলের সঙ্গে সায়গলের ফোন থেকেই যোগাযোগ রাখতেন অনুব্রত। গোরু পাচার কাণ্ডে তার সরাসরি যোগের তথ্য এসেছে সিবিআই’র হাতে। মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তেও আসে এই পুলিশকর্মীর নাম। তদন্ত শুরু করে ইডি। আসানসোল জেলে গিয়েই জেরার পরে তাকে হেপাজতে নেয় ইডি। তবে তাকে দিল্লি নিয়ে যেতে গিয়ে বিস্তর কালঘাম ছোটে তদন্তকারী আধিকারিকদের। নিম্ন আদালত ও কলকাতা হাইকোর্টে সেই আবেদন খারিজ হলেও দিল্লি হাইকোর্ট ইডি’র আবেদন মঞ্জুর করেছিল।
অনুব্রতও কী এই পরিণতি টের পাচ্ছেন? তাই কী ইডি জেরার পরে তাঁকে ‘শোন অ্যারেস্ট’ করা হলেও আসানসোল জেলে অ্যারেস্ট মেমোতে সই না করার জন্য দীর্ঘক্ষণ নাটক করেন বীরভূমের এই দাপুটে তৃণমূল নেতা?
নিজের মেয়ের বয়ানেই চাপে পড়ে যাওয়ায় কী ইডি’র জেরায় শাঁখের করাতের মতো অবস্থা হয়েছে অনুব্রতর? মেয়েকে সেফ প্যাসেজ দেবেন নাকি নিজেকে?
এদিকে এদিনই ফের দিল্লির আদালতে সায়গল হোসেনকে তোলা হলে বিচারক তার জেল হেপাজতের মেয়াদ বাড়িয়ে দেন। আরও ১৪দিন তিহাড় জেলে থাকতে হবে অনুব্রতর দেহরক্ষীকে। এই পর্বে কী তবে অনুব্রতর সঙ্গে তিহার জেলেই সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন গোরু পাচারে যুক্ত এই পুলিশকর্মী?
Comments :0