ISRAEL INDIA

ইজরায়েলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে সরব বিশ্ব, ভারত চুপ!

আন্তর্জাতিক

একবছর পার হয়ে গেল, গাজায় ইজরায়েলের হামলা চলছে, সেই সঙ্গে হামলাকে প্রসারিত করা হয়েছে লেবাননে। গাজায় ইজরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল সহ নানা অসামরিক পরিকাঠামো। মৃত্যু হয়েছে ৪২হাজারেরও বেশি নাগরিকের, মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট’এর পরিসংখ্যানে এদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী। গাজার ৮০ শতাংশের বেশি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন ১৯ লক্ষ মানুষ। এখন সারা বিশ্বের কাছে বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা। কারণ ইরানকেও এই যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে। ইজরায়েল সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে বোমা হামলা চালিয়েছে, সেই হামলায় গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক ও সামরিক অফিসারদের মৃত্যু হয়েছে। ইজরায়েল সিরিয়া আক্রমণও করেছে। ফলে পশ্চিম এশিয়া সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। 
কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিই ইজরায়েলকে প্রত্যক্ষ মদত দিতে নেমেছে। তৈল ভাণ্ডার মধ্য প্রাচ্যে তাদের ঘাঁটি জোরদার করাই লক্ষ্য। আমেরিকার এই উদ্দেশ্য সহজবোধ্য। অসলো চুক্তি মাফিক স্বাধীন প্যালেস্তাইনের অস্তিত্বকে ইজরায়েল মুছে দিতে চাইছে মার্কিন মদতে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্দেশও তারা মানছে না। কিন্তু ইউরোপ সহ সারা বিশ্বেই শান্তিকামী মানুষ ইজরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকার তীব্র নিন্দায় মুখর হচ্ছেন। এমনকি আমেরিকার অভ্যন্তরেও বিক্ষোভ হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সহ বিশ্বের ৪৯টি বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট পার্টি এক যৌথ বিবৃতিতে গাজা এবং লেবানন থেকে ইজরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার, বন্দিদের মুক্তি সহ, ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী একটি সার্বভৌম প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য ইজরায়েলের সমালোচনা করেছে এবং গণহত্যা বন্ধের প্রস্তাব করেছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, ভারত সরকারের ভূমিকা। ভারতের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ঐতিহ্য এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ভারত তার অঙ্গীকার সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ থেকে ভারত বিরত থেকেছে। জোট নিরপেক্ষতার বদলে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এখন বহুমুখী বোঝাপড়ার অদ্ভুত তত্ত্ব শোনাচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরেই ভারত সহ বিশ্বের উপনিবেশ থাকা দেশগুলি স্বাধীন হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সাম্রাজ্যবাদের হাত ওঠার পরে বর্তমান বিশ্বে সামরিক সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব ইতিহাস হয়ে গেছে। ব্যতিক্রমের মতো পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইজরায়েল। ইজরায়েলের এই ভূমিকার বরাবরের বিরোধিতা এবং প্যালেস্তাইনের মানুষের প্রতি সংহতিই ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা ভারতের অবস্থান। আফ্রো-এশীয় জনগণের উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তি ও সংহতির প্রতি ভারত ছিল দায়বদ্ধ। দুঃখের কথা সেটাই এখন ঝাপসা হয়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আরএসএস’র ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের চাপে। যারা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অনুকরণীয় বলেছিল, তারা ইজরায়েলের জায়নবাদকেও সমর্থনযোগ্য মনে করে। ফলে ভারত এখন এশিয়া আফ্রিকার তৃতীয় বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। 
আমাদের কলকাতা শহরের বুকে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবিরোধী গণসংগ্রামের ঐতিহ্য রয়েছে। ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের সময় এই শহরের মানুষই ‘তোমার নাম, আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’ বলে স্লোগান তুলেছিল। কিন্তু ভারতের মানুষ এখন এটা জেনে আঁতকে উঠতে পারেন যে ভারতবাসীর অর্থ ও সম্পদ বিনিয়োগীকৃত হচ্ছে ইজরায়েলকে সমরাস্ত্র জোগানোয়। যে অস্ত্র ব্যবহার করে ইজরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে তার কিছু কিছুর উৎপাদনও হচ্ছে ভারতে। ভারতের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি আদানিদের মুনাফা বাড়ছে গাজায় নারী শিশুর রক্তের বিনিময়ে। প্যালেস্তাইনে নির্বিচারে মানুষ মারতে ইজরায়েল বোমা বর্ষণের জন্য যে দ্রোন ব্যবহার করছে তার উৎপাদন করছে আদানি গোষ্ঠী। ইজরায়েলের সমরাস্ত্র উৎপাদনের কোম্পানি এলবিট সিস্টেমের সঙ্গে চুক্তি মাফিক আদানি গোষ্ঠী হায়দরাবাদে দ্রোন তৈরি করে তা সরবরাহ করছে। আর ভারত সরকার হায়দ্রাবাদে আদানিদের এই উৎপাদনের জন্য সরকারি অনুদান জোগাচ্ছে। একইভাবে ভারত সরকার ইজরায়েলকে অর্থনৈতিকভাবে পুষ্ট করতে সেখানে তৈরি বিভিন্ন সামরিক ও নজরদারি সরঞ্জাম কিনছে। ভারতের যুদ্ধবিরোধী ঐতিহ্যের থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে মোদী সরকার। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যের তেল ভাণ্ডার। উপসাগরীয় এলাকার তেলের ভাণ্ডারকে তারা তাদের স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ-এর অংশ বলে মনে করে। ইজরায়েল কেন সামরিক সম্প্রসারণ পশ্চিমে করতে চাইছে সেটা এই মার্কিন মনোভাব থেকে বোঝা যায়। এখানে ইজরায়েল কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর একটি বাহু হিসাবে। এই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে বিবাদ মেটাতে নারাজ এবং ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে শাসক বদলে সক্রিয় রয়েছে। 
পশ্চিম এশিয়ার এই ঘটনাবলীকে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ উদ্বেগজনক ঘটনা হিসাবেই দেখছে। সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়া নিয়ে ৪৯টি কমিউনিস্ট পার্টি একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)ও তাতে স্বাক্ষর করেছে। এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা, কমিউনিস্ট এবং ওয়ার্কার্স পার্টিগুলি পশ্চিম এশিয়াতে শান্তি এবং উন্নতির জন্য প্রচার করে চলেছি। এখন লেবাননের ওপর ইজরায়েলের বহুমুখী ক্রমবর্ধমান আক্রমণ এবং পূর্ণমাত্রায় অনুপ্রবেশের ফলে এই অঞ্চলে যে নজিরবিহীন অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেই সম্পর্কে আমরা গভীর আশঙ্কা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছি। ইরানের সার্বভৌমত্ব এবং লেবাননের ওপর যেসব উসকানিমূলক নিয়মবিরুদ্ধ আইনবিরুদ্ধ ইজরায়েলী হামলা চলছে, তার ফলেই ইরান, ইজরায়েলের ওপর পালটা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে বলে মত প্রকাশ করে এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস, এই ধারায় ঘটনাবলী যদি চলতেই থাকে, তবে এই অঞ্চলগুলি দ্রুত পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এক সর্বগ্রাসী চক্রে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। তার ফলে তৈরি হবে এক বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি। স্বাভাবিকভাবেই, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে, আমাদের দেশগুলির এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে।
ইজরায়েলের নেতানিয়াহু সরকারকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিধিনিয়মের খেলাপ করে নেতানিয়াহু সরকার গত ১২ মাস ধরে গাজায় লাগাতার গণহত্যা-যুদ্ধ চালাচ্ছে। তেহরান এবং বেইরুটে রাজনৈতিক নেতাদের নির্মমভাবে খুন করে চলেছে। এখন লেবাননে অনুপ্রবেশসহ সাংঘাতিক সব সন্ত্রাসমূলক যুদ্ধকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে যাতে, গোটা পশ্চিম এশিয়া জুড়ে তাদের শত্রুরা নির্মূল হয় এবং আরও ব্যাপক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, এ সবই হলো মার্কিন এবং বৃটিশ সরকারের সঙ্গে তাদের অশুভ আঁতাতের ফল; যার উদ্দেশ্য হলো, পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রের পুনর্গঠন। তাই ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পরিকল্পনামাফিক আক্রমণাত্মক যোগসাজশ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছে, যাতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য এবং দমন প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের দীর্ঘ দৃঢ় মুঠো পশ্চিম এশিয়ায় শক্ত করার জন্য ইজরায়েলকে ব্যবহার করছে, কখনও লাগাতার আড়াল করে চলেছে, কখনও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ক্রমাগত সমর্থন করে চলেছে। আর ইজরায়েল পশিম এশিয়া দখল অভিযানে অগ্নিসংযোগকারীর ভূমিকা পালন করছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে আক্রমণাত্মক কৌশল বজায় রেখে চলেছে।
কমিউনিস্ট পার্টিগুলির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা মনে করি পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হলো, প্যালেস্তাইনের সমস্যার সুনির্দিষ্ট শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান। তাই আমরা, অবিলম্বে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে গণহত্যার শেষ চাইছি। এইসব অঞ্চল থেকে  সমস্ত ইজিরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। ইজরায়েলের জেলে বন্দি এবং ডিটেনশন সেন্টারে আটক সমস্ত প্যালেস্তিনীয়দের, গাজায় আটক ইজরায়েলী বন্দিদেরও মুক্তি দাবি করছি। তার সঙ্গে আমাদের দাবি, ৪ জুন, ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নীতি অনুযায়ী যেমন সকলে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সার্বভৌম প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পাশে দাঁড়িয়েছিল, তেমনভাবেই তাকে পুনর্বহাল এবং বাস্তবায়িত করতে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট আইনি পদক্ষেপ এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবিলম্বে প্যালেস্তাইনে অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটাতে হবে। লেবানন এবং প্যালেস্তিনীয় জনগণের সংগ্রামের প্রতি আমরা সংহতি জানাচ্ছি। বৈদেশিক অনুপ্রবেশ, আগ্রাসন, দখলদারিকে প্রতিহত করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের মৌলিক এবং সার্বিক অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করছি। লেবাননের সার্বভৌম ভূখণ্ড থেকে সত্ত্বর সমস্ত ইজরায়েলী সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, ইরান সহ ঐ অঞ্চলগুলিতে লাগাতার বোমাবর্ষণ এবং সামরিক আক্রমণের ধ্বংসলীলা বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। আমরা চাই, সমস্ত গোলাবারুদ-যুদ্ধাস্ত্র ক্ষেপণাস্ত্র রপ্তানি এবং ইজরায়েলকে প্রযুক্তিগত সাহায্য করা বন্ধ করতে হবে, যাতে তারা প্যালেস্তাইন এবং লেবাননে তাদের ধ্বংসাত্মক নজিরবিহীন বিপজ্জনক সামরিক পরীক্ষা এবং অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কাছে দাবি— গাজায় ইজরায়েলের গণহত্যা এবং যুদ্ধ বিষয়ক রায়গুলি বহাল রাখা হোক এবং অবিলম্বে সেগুলি বিনা বাধায় কার্যকর করা হোক। আমরা সকল পক্ষের কাছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের আবেদনের প্রতি নজর দিতে অনুরোধ করছি। এই অঞ্চলের জনসাধারণের জন্য বিপর্যয়কারী এক বৃহৎ ব্যাপক দুঃস্বপ্নের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা থেকে সরে এসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সকলে আন্তরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে আবেদন জানাচ্ছি।
 

Comments :0

Login to leave a comment