অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বুধবার তাঁর পঞ্চম বাজেটকে অভিহিত করেছেন ‘অমৃত কালের প্রথম বাজেট হিসাবে’। বাজেট ভাষণ শেষ হলে বোঝা গেল, অমৃতের ভাগটুকু গেছে অতি-ধনীদের কাছে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাগে পড়েছে বিষটুকুই।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট এবং দেশের প্রতিদিনের মধ্যে বাস্তবতা এতই প্রবল যে নিরন্তর ভারী ভারী অবোধ্য শব্দ ব্যবহার করেও তা আড়াল করা যায়নি। এমনকি ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতির চেহারায় জনমুখী প্রলোভনও দেখাননি তিনি। অর্থনীতি সঙ্কোচনে, অর্থনৈতিক সমীক্ষায় মোট অভ্যন্তরীণ বৃদ্ধির হার কমছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমছে, শিল্প উৎপাদনের হার প্রায় তলানিতে, মুদ্রাস্ফীতি যে এখনই নিয়ন্ত্রণ হবে না, সমীক্ষায় বলা হয়েছে সে-কথাও।
গ্রামীণ দুর্দশা, কৃষিতে সঙ্কট, কর্মসংস্থানের সঙ্কট প্রবল। কিন্তু এর কোনো কিছুকেই মাথায় না রেখে বাজেট পেশ করা হয়েছে এদিন।
সীতারামন কর কাঠামোর যে পরিবর্তন করেছেন তাতে মধ্যবিত্তের লাভ বলে প্রচার হলেও আসল লাভ অতি-ধনীদের। ২ কোটি টাকার ওপরে যাদের আয় তাদের কার্যকরী কর ৪২ শতাংশ থেকে নেমে এলো ৩৯ শতাংশে। সারচার্জের সর্বোচ্চ হারও নেমে এসেছে ৩৭ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে। অক্সফামের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টেই দেখা গেছে অতি ধনী ১০ শতাংশের তুলনায় সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকা ৫০ শতাংশ ছ’গুণ বেশি পরোক্ষ কর দেন। অথচ এবারের বাজেটে পরোক্ষ কর, বিশেষ করে পণ্য পরিষেবা কর থেকেই বিপুল রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অন্যদিকে, কোপ পড়েছে জনগণের ঘাড়ে। যখন ভারত বিশ্বের অন্যতম ক্ষুধা-অপুষ্টির দেশ হয়ে উঠেছে তখন খাদ্যে ভরতুকি কমানো হয়েছে ৩১ শতাংশ। গণবণ্টনে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনে খাদশস্য সংগ্রহের জন্য ২০২২-২৩ সালের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭২,২৮২ কোটি টাকা। এবার তা কমিয়ে করা হয়েছে ৫৯,৭৯৩ কোটি টাকা। প্রায় ১২ শতাংশ ছাঁটাই। টাকার মূল্যে ১২,৫০০ কোটি টাকা। মিড ডে মিলের প্রকৃত বরাদ্দ ৯.৪ শতাংশ কমানো হয়েছে। পুষ্টিভিত্তিক ভরতুকি ছাঁটাই হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।
কর্মসংস্থানের আকালের মুখে কোনো নতুন প্রকল্প তো নেই-ই, গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবথেকে লক্ষণীয় ১০০ দিনের কাজ বা রেগায় বরাদ্দ ছাঁটাই। এক বছর আগের ৮৯,০০০ কোটি থেকে কমিয়ে এবার রেগায় বরাদ্দ ৬০,০০০ কোটি। বিশেষজ্ঞরা অঙ্ক করে দেখেছেন যাঁরা গত বছর কাজ পেয়েছিলেন শুধুমাত্র তাঁদেরই কাজ দিতে হলে এই বরাদ্দে কুলোবে না। কর্মসংস্থানের জন্য সীতারামন মিশন মোডে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখাতে পারেননি।
গুরুতর আঘাত কৃষি ক্ষেত্রেও। ২০২২-২৩’র বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১,২৪,০০০ কোটি টাকা। তা এবারের বাজেটে কমে দাঁড়িয়েছে ১,১৫,৫৩১ কোটি টাকা। যে দাবি নিয়ে কৃষকরা দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়েছেন সেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনী নিশ্চয়তা এবারের বাজেটেও নেই। বরং খাদশস্য সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দাম স্থির রাখার জন্য সরকারী হস্তক্ষেপের যে ব্যবস্থা ছিল তা লোপ করা হয়েছে। সারে ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে ২২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ৫০ হাজার কোটি টাকা। সারের দাম বাড়বে এবং কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে।
মহামারীর সময়ে দেখা গিয়েছিল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা। সীতারামনের দাবি অনুযায়ী এবার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে। বাস্তবে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে ৩৪ শতাংশ বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় বিপুল হ্রাস হয়েছে। বস্তুত এই বিমার ভবিষ্যৎ নিয়েই এদিন প্রশ্ন উঠে গেছে।
তেমনই শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেটে যে বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়েছে তা মুদ্রাস্ফীতির হারের প্রায় সমান। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে কোনো বৃদ্ধিই হয়নি।
সর্বোচ্চ হারে ছাঁটাই হয়েছে পেট্রোপণ্যের ভরতুকি। চলতি অর্থবর্ষে তা ছিল ৯১৭০ কোটি টাকা। তা কমে হবে ২২৫৭ কোটি টাকা। এ থেকে ইঙ্গিত, পেট্রোপণ্যের দাম বাড়বে আবার।
সীতারামনের এদিনের বক্তৃতায় মূলধনী ব্যয় নিয়ে বাগাড়ম্বর করা হলেও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ প্রায় কিছুই নেই। অল্প কয়েকটি প্রকল্পের নাম করেই কাজ সেরেছেন অর্থমন্ত্রী। খুবই সাবধানী হয়ে ‘বিরাষ্ট্রীয়করণ’ শব্দটি এড়িয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন ১১ শতাংশ।
অমৃতকালের মর্মে কী রয়েছে, তার আরেকটি উদাহরণ সংখ্যালঘুদের জন্য বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ হ্রাস। সংখ্যালঘু উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৩০৯৭ কোটি টাকা। গত বছরেও এই ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল ৫০২০ কোটি টাকা। গত বছরের বরাদ্দের একটি বড় অংশ সরকার খরচ করেনি।
অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কোষাগারীয় ঘাটতি হবে ৫.৯ শতাংশ। এই ঘাটতি তিনি ২০২৫-২৬-এ হবে ৪.৫ শতাংশ। ঘাটতি কমাতে সরকার কার্যত বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেছে। বিপুল ঋণ নেওয়া হবে, তা-ও ঘোষণা করা হয়েছে।
Comments :0