ট্রামের জমি-সম্পদ কৌশলে জমি হাঙড়দের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত রোখার আহ্বান জানালো সিপিআই(এম)। কলকাতার ঐতিহ্য, দেড়শো বছর ধরে এই শহরে চলা ট্রামকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চলছে তৃণমূল সরকারের মদতে। পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি খরচ সাশ্রয়কারী এই যানকে দিনে দিনে রুগ্ণ করে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছে তৃণমূল। কোনও কারণ ছাড়া একের পর এক ট্রাম রুটগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার ছিল ট্রামের কলকাতায় চলায় ১৫০ বছর। এদিনই এই ঐতিহ্যমণ্ডিত যানকে তুলে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা কমিটির ডাকে কলকাতার ১০টি ট্রাম ডিপো এলাকায় তীব্র বিক্ষোভে সোচ্চার হলেন পার্টি নেতৃত্ব ও কর্মীরা। দাবি, সাধারণ মানুষের স্বার্থে যে কোনভাবেই ট্রামকে বাঁচাতে হবে। এজন্যে অবিলম্বে পুরানো সমস্ত ট্রাম রুটগুলি চালু করতে হবে। সরকারি ব্যয় বরাদ্দে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে ট্রামের সম্পদ ও জমিকে। নাহলে আগামী দিনে আরও বৃহত্তর আন্দোলনে উত্তাল হবে লাল ঝান্ডা।
কলকাতার উলটোডাঙ্গা, বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, ধর্মতলা, নোনাপুকুর, গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, কালীঘাট, খিদিপুর ট্রামডিপোর সামনে বিক্ষোভ দেখান সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ও কর্মীরা। উলটোডাঙ্গা ট্রাম ডিপোর সামনে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক কল্লোল মজুমদার।
এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তরুণ ব্যানার্জি, কনীনিকা ঘোষ, দেবাঞ্জন চক্রবর্তী, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, দেবেশ দাস, রত্না দত্ত, মধুজা সেন রায়, সুদীপ সেনগুপ্ত, ফৈয়াজ আহমেদ খান সহ নেতৃবৃন্দ। পূর্বে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এদিন অর্থাৎ শুক্রবার কলকাতার ট্রামের ১৫০ বছর পূর্তির দিনে বিক্ষোভ আন্দোলনে শামিল হয়ে ‘ট্রাম বাঁচাও’-এর দাবিতে সোচ্চার হলেন পার্টি নেতৃত্ব ও কর্মীরা।
ট্রাম রুটগুলি বন্ধ করার পেছনে রাজ্য সরকারের প্রধান অজুহাত ছিল যানজট, দ্বিতীয় অজুহাত ট্রামের শ্লথ গতি। কিন্তু এই যুক্তি আদৌ ধোপে টেকে না বলে মন্তব্য করেছেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। সাধারণ মানুষের পালটা যুক্তি, ধর্মতলা-খিদিরপুর রুটে কোনও যানজট নেই, তাহলে সেখানে ট্রাম বন্ধ কেন। অভিযোগ, আমফানের সময়ে ওই রুটে ওভারহেডের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ার পরেও কাজ হয়নি, উপরন্তু তারগুলি চুরি হয়ে গেছে। অন্যদিকে গালিফ স্ট্রিট থেকে বিবাদী বাগ রুট যা গেছে রবীন্দ্র সরণির ওপর দিয়ে, সেখানেও বন্ধ ট্রাম চলাচল, ওই রাস্তায় পিচ ঢেলে দেওয়ার কথা বলেছেন কলকাতার মেয়র।
তেমনই মা ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হওয়ার পর পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপো এলাকায় ট্রাম চালাতে এখন কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু কোনও উদ্যোগ নেই সরকারের। একইভাবে বেলগাছিয়া ও শিয়ালদহে দুর্বল ব্রিজের অজুহাতে ট্রাম বন্ধ রাখা হয়েছে কিন্তু ট্রামের থেকেও অত্যন্ত ভারী পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলে কোনও নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, উলটোডাঙ্গা ট্রাম ডিপো থেকে কোনও কারণ ছাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ট্রাম চলাচল। এভাবেই ক্রমশ ধ্বংস করা হয়েছে ট্রামকে। অথচ যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে রাস্তায়।
সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, ২০১১ সালে যেখানে কলকাতার ৩৭টি রুটে ট্রাম চালানো হতো, গাড়ি মজুত ছিল প্রায় ২২০টি। তার মধ্যে প্রতিদিন চালানো হতো ১০০ থেকে ১১০টি। এখন অর্থাৎ ২০২৩ সালে মাত্র ২টি রুটে ট্রাম চালানো হয়। এখন মজুত ট্রামের সংখ্যা ২০টি, চলে দিনে ১১ থেকে ১২টি। স্থায়ী কর্মীর সংখ্যাও কমে গেছে হুহু করে। কিন্তু এখনও ৭৫ থেকে ৮০টি ট্রাম এমন অবস্থায় আছে যে পুরানো রুট চালু করে সেগুলিকে নিয়মিত চালানো সম্ভব। কিন্তু সম্পূর্ণ উদাসীন সরকার। শুধু তাই নয়, উপরন্তু ট্রাম লাইনের ওপর পিচ ঢেলে দিতে চাইছে সরকার, খুলে নেওয়া হচ্ছে ওভারহেড তার। অভিযোগ, ৩৭টি ট্রামকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু কেন এই অবস্থা।
তবে কি জমি হাঙড়দের হাতে ট্রামের জমি ও সম্পদ তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে গোপনে? প্রশ্ন তুলেছেন সিপিআই (এম) নেতৃত্ব। জানা গেছে টালিগঞ্জ, কালীঘাট, বেলগাছিয়া, গ্যালিফ স্ট্রিট, খিদিরপুর— এই ৫টি ট্রাম ডিপোর প্রায় ৩৫০ কাঠা জমি ২৩০ কোটি টাকায় ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিক্রি করেছে সরকার। কিন্তু এই টাকা ট্রামের পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ হলো না।
টালিগঞ্জের জমিতে শপিং মল, গড়িয়াহাটের জমিতে কফি শপ ইত্যাদি পরিকল্পনা হচ্ছে কিন্তু ট্রাম চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। শুধু হেরিটেজ নাম দিয়ে ২-৪টি ট্রাম চালিয়ে লাভ কি হবে। ট্রাম তো পরিবেশবান্ধব এবং কিছুটা কম ভাড়াতে যাতায়াত করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। পার্টি নেতৃত্বের বক্তব্য, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে যেখানে প্রতি বছর ট্রামের জন্য বাজেট বরাদ্দ করেছিল, বিনিয়োগ বাড়িয়েছিল, সেখানে তৃণমূল সরকার ট্রামকে তুলে দিয়ে ট্রামের সম্পত্তি হস্তগত করতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে আগামী দিনে আরও বৃহৎ আন্দোলনে শামিল হবে সিপিআই(এম)।
Comments :0