Editorial

মোদী বিহনে ভাগবতের স্বাধীনতা

সম্পাদকীয় বিভাগ

স্বাধীনতার প্রকৃত মর্মার্থ সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সাধারণ মানুষের যে ধারণা তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে ধর্মান্ধ কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। আর এই বিশেষ ধরনের উদ্ভট চিন্তার মানুষদের স্বাধীনতার উৎস আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের বিশ্বজ্ঞানের আলোকবর্জিত অন্ধকূপ। মোহন ভগবত তাদেরই ভাষ্যমুখ। তাই তিনি দাবি করেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তাড়িয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল সেটা নাকি আসল স্বাধীনতা ছিল না। ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করেছে গত বছর জানুয়ারি মাসে অযোধ্যায় পাঁচশো বছরের পুরানো বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপর গড়ে তোলা রামন্দিরের প্রতিষ্ঠা বা উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। বলা বাহুল্য, মোহন ভাগবতকে পাশে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী মন্দিরের উদ্বোধন করেছিলেন। অর্থাৎ মোদী-ভাগবতের হাতেই ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা। দুশো বছর ধরে অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে, লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এনেছিলেন তার কোনও স্বীকৃতি বা মান্যতা নেই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস-বিজেপি’র কাছে। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কোনও ভূমিকা বা অবদান নেই আরএসএস’র। স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ লক্ষ শহীদের তালিকায় নেই একজন আরএসএসও। উলটে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের নানাভাবে সাহায্য করেছে আরএসএস নেতা-কর্মীরা। স্বয়ং সাভারকার তো ব্রিটিশদের সাহায্য করার এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ না নেবার মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। সেই সময়ই আরএসএস স্বাধীনতাকে স্বীকার করেনি, মেনে নেয়নি জাতীয় পতাকাকে, এমনকি আম্বেদকর প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকেও। মনে মনে তারা মান্যতা দেয় অন্য এক পতাকাকে এবং মনুবাদের অনুসারী ব্রাহ্মণ্যবাদী সংবিধানকে। যে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ওপর ভিত্তি করে আরএসএস ভারত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে দৃঢ় সেই ধর্মান্ধতার রাজনৈতিক মতাদর্শে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ভারতের পরাধীনতার কারণ নয়। অর্থাৎ ব্রিটিশরা পরাধীন ভারতের ঔপনিবেশিক শাসক এটা আরএসএস মনে করে না। তাই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম বলেই মনে করে না। আরএসএস’র ভাষ্যে প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশরা তাদের সহযোগী বা মিত্র শক্তি। তাই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা অংশ নেয়নি। আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী ভাবনায় ব্রিটিশদের কারণে ভারত পরাধীন হয়নি, পরাধীন হয়েছে ভারতে মুসলিম আগমনের পর। অর্থাৎ মুসলিম শাসনকালেই আরএসএস’র ভাগ্য মতে ভারত প্রকৃত অর্থে পরাধীন হয়। কিন্তু মুসলিম যুগে আরএসএস’র মতো ধর্মান্ধ উদ্ভট ভাবনার জন্ম না হওয়ায় মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করার প্রশ্নই ওঠেনি। আরএসএস’র ছাতার তলায় গজিয়ে ওঠা আজকের রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা মনে করে এবং বিশ্বাসও করে যে ব্রিটিশরা এসে ভারতকে মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত করেছে। তাই আরএসএস মার্কা স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশরা সহযোগী শক্তি।
ব্রিটিশদের তাড়িয়ে যদি হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করা যেত তবেই আরএসএস মনে করত ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু যেহেতু সেটা হয়নি তাই তারা ১৫ আগস্ট দেশ প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছে বলে মনে করে না। ব্রিটিশদের সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে নতুন ভারত গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে সংবিধান তৈরি হয়েছে। এমন ভাবনা থেকেই অধুনা বিজেপি সাংসদ কঙ্গনা রানাউত বলেছিলেন ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছে ২০১৪ সালে মোদীর নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক বিজেপি’র সরকার হবার পরে। এবার মোহন ভাগবত বললেন অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠাই ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা। মহাকাব্যে নায়ককে কল্পিত দেবতা বানিয়ে সেই দেবতার কাল্পনিক জন্মস্থানে তার মন্দির নির্মাণ হলো হিন্দুত্ববাদীদের জ্ঞানে দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা। উদ্ভট ভাবনার এমন নজির বিশ্বে বিরল।

Comments :0

Login to leave a comment