রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবে শক্তিপদ দাসের হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে সঞ্জয় মালহোত্রার হাতে তুলে দেবার পর থেকে সরকারের আপাত স্বস্তি বেড়েছে সন্দেহ নেই। অন্তত গত কয়েক মাসে মালহোত্রার কার্যকলাপেই তার প্রমাণ। মালহোত্রা দায়িত্ব পাবার পর যথেষ্ট সন্তুষ্ট দেশের কর্পোরেট মহলও। যে কোনও দেশেরই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সঙ্গে কর্পোরেট মহলের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কর্পোরেট পুঁজির একমাত্র লক্ষ্য তাদের মুনাফা। এই মুনাফার জন্যই তারা উৎপাদন করে, ব্যবসা করে, পুঁজি বিনিয়োগ করে, বিদেশি রপ্তানি করে। তাই তারা মনে করে পুঁজি হোক সবচেয়ে সস্তা। অর্থাৎ সুদের হার হোকে শূন্য বা শূন্যের কাছাকাছি। যত কম সুদ হবে ততই তারা সস্তায় ঋণ নিতে পারবে ব্যাঙ্ক থেকে বিনিয়োগের জন্য। তেমনি আজকাল কর্পোরেট সংস্থা বিনিয়োগের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে যত ঋণ নেয় তার কাছাকাছি ঋণ নেয় সাধারণ ক্রেতারা। গাড়ি, বাড়ি, আসবাব সহ নানা ধরনের পণ্য কেনার জন্য মানুষ ঋণ নেন এবং মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করেন। ইদানীং পড়াশুনার জন্য ঋণ নেবার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। কর্পোরেট চায় সুদের হার কম থাকলে ক্রেতারা অনেক বেশি ঋণ নিয়ে অনেক বেশি জিনিস কিনবেন। তাতে তাদের বিক্রি বাড়বে, মুনাফা বাড়বে। একারণেই কর্পোরেট তথা বণিক মহল সব সময়ই সুদের হার কমানোর জন্য সরকারের উপর প্রবল চাপ দিয়ে থাকে। সরকার যদি মোদী সরকারের মতো অতিরিক্ত কর্পোরেট বান্ধব হয় তাহলে সরকারের তরফেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর চাপ বাড়ানো হয় সুদের হার কম রাখার জন্য।
অর্থনীতি যদি বিজ্ঞান হয় তাহলে তাকে নিজের পথেই চলতে হয়। কারও ইচ্ছা অনিচ্ছা বা কোনও গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে চলতে পারে না। তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের ঋণনীতি নির্ধারণের সময় অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয় মূল্যবৃদ্ধিকে। বাজারে পণ্য ও পরিষেবার জোগান ও চাহিদা যেমন পণ্য মূল্য বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে তেমনি বাজারে নগদের জোগানও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তাই বাজারের নগদের জোগানের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে-কমিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। রেপো রেট, রিজার্ভ রেপো রেট, ক্যাশ রিজার্ভ রেসিও ইত্যাদি কমিয়ে-বাড়িয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই কাজটি করে থাকে। বস্তুত এটাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান কাজ। প্রতি দু’মাস অন্তর ঋণনীতি কমিটি বসে পর্যালোচনা করে সুদের হার কমানো-বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
মোদীর অতি ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত আমলা মালহোত্রা দায়িত্ব নেবার পর গত তিন দফায় সুদের হার ১.৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। শেষ দফায় সবাইকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে ০.৫ শতাংশ রেপো রেট কমানো হয়েছে। এটা কর্পোরেট মহলও প্রত্যাশা করেনি। আরও এক ধাপ এগিয়ে ক্যাশ রিজার্ভ কমিয়ে বাজারে অতিরিক্ত আড়াই লক্ষ কোটি টাকা নগদের জোগান বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনুমান করেছেন চলতি আর্থিক বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার গড়ে ৩ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। অর্থাৎ আগামী দিনে সুদের হার আরও অনেকটা কমিয়ে দেবার বার্তা দিয়ে দিয়েছেন। এতে কর্পোরেট মহল দারুণ খুশি সন্দেহ নেই। কিন্তু যে অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত অর্থের সুদের উপর নির্ভর করে বাঁচেন তাদের কথা মালহোত্রা ভেবেছেন কি? এমন গ্যারান্টি কি তিনি দিচ্ছেন এতে হু হু করে বিনিয়োগ বাড়বে। বাজারে বিক্রি বেড়ে যাবে, অর্থনীতি চনমনে হয়ে উঠবে?
Editorial
সুদের হার তো কমলো তারপর!

×
Comments :0