২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসাবে কাতারের নাম ঘোষণা হবার পর থেকেই চলছে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক। কাতারের মতো ছোট দেশে বিশ্বকাপ কেন আয়োজিত হবে? বহু ফুটবল বিশেষজ্ঞ, ইউরোপের অনেক ফুটবল খেলিয়ে দেশ প্রশ্ন তুলেছিল। নেদারল্যান্ডসও বিশ্বকাপ বয়কটের দাবি জানিয়েছিল। কাতার সরকার প্রচুর বিধিনিষেধ জারি করেছিল। যে জন্য আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায় পশ্চিমী মহল। কাতার সেসবকে খুব বেশি পাত্তা দেয়নি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সুষ্ঠুভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করা। রবিবার বিশ্বকাপের শেষদিন। ইতিমধ্যেই ফিফা সভাপতি জিওভানি ইনফান্তিনে কাতারকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ আয়োজিত হলো কাতারে। সবদিক থেকেই বলা যায় কাতার লেটারমার্কস নিয়ে পাশ করেছে। ইনফান্তিনোর মতকে সমর্থন জানিয়েছে অনেকেই। তারপরও নানা মুনির নানা মত থাকবেই, তাই এখনও বহু মানুষ সমালোচনা করে চলেছে। কারোর মতে, টাকার বিশ্বকাপ হলো এটা, কোথাও বিশ্বকাপের প্রাণ ছিল না। নেইমার জুনিয়র, লিওনেল মেসিরা আলোকিত করেছে কাতার বিশ্বকাপকে।
পশ্চিমী দুনিয়া সারা বিশ্বকে উপনিবেশ বানিয়ে রেখে তাদের সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কাতার সেখানে উলটো স্রোতে হেঁটে নিজেদের সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। নিরাপত্তার ব্যাপারটি এতটাই দৃঢ় ছিল, বিশ্বকাপ চলাকালীন কোনও সমর্থক গ্রেপ্তার হয়েছে বলে কোনও খবর নেই। এমনকি ইংল্যান্ড সমর্থকরা খুবই ভয়ানক আচরণ করে, বিশ্বকাপের সময়ে। এবারে নজির, কোনও ব্রিটিশ সমর্থককে পুলিশের হেপাজতে পড়তে হয়নি। এক মহিলা সমর্থক বলছিলেন, এবার কাতারে অপরাধ মাত্রা একেবারে কম। রাস্তায় তাঁদেরকে উসকানিমূলক মন্তব্য শুনতে হয়নি। প্রতিটা দেশের এত সমর্থকদের চাপ কাতারের মতো ছোট্ট দেশ দারুণভাবে সামলেছে। ফুটবলের সংস্কৃতি না থাকা একটা দেশও যে এত সুন্দরভাবে আয়োজন করেছে তার প্রশংসা করতেই হয়।
বলতেই হয়, কাতার বিশ্বকাপেই ফুটবল অনুরাগীরা সাক্ষী থেকেছেন একের পর এক অনন্য রেকর্ডের! ‘ফেভারিট’ তকমা পাওয়া অনেক দলের বিদায় থেকে শুরু করে এশিয়া ও আফ্রিকার দলগুলির উত্থান কিংবা সর্বোচ্চ সংখ্যক দর্শক উপস্থিতি। ম্যাচ প্রতি দর্শক হয়েছে ৫১ হাজার। শুধু স্টেডিয়াম কিংবা দোহার রাস্তাতেই নয়, টেলিভিশনেও ফুটবল উপভোগ করা দর্শকসংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়েছে কাতার বিশ্বকাপে এসে। টেলিভিশনে সংখ্যাটা রেকর্ড ভেঙেছে। ইনফান্তিনোর কথায়, ‘আমরা ইতিমধ্যে ২০০ কোটির বেশি দর্শক পেয়েছি, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য! ২৫ লাখ মানুষ দোহার রাস্তায় দাঁড়িয়ে এবং লাখো মানুষ প্রতিদিন স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখেছেন। তারা সম্মিলিতভাবে উল্লাস করেছেন এবং নিজেদের দলকে সমর্থন দিয়েছেন।’
দারুণ সব বিশ্বমানের স্টেডিয়াম। প্রত্যেকটি মাঠ দারুণ। এখনও মনে রয়েছে, ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের একটি মাঠের অবস্থা ছিল অনেকটা খাটালের মতো। দর্শক, সমর্থকরা অ্যালকোহল ছাড়া শুধু মাত্র অবিরত ভাবে ড্রাম পিটিয়ে স্টেডিয়ামের পরিবেশ মাতিয়ে রেখেছে। ফুটবলারাও উপভোপ করেছেন। প্রায় প্রতিটি ম্যাচই হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক। ম্যাচ প্রতি গোল হয়েছে ২.৬৩। মোট ১৬৩ গোল। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বাধিক গোলের আসর (১৯৯৮ ফ্রান্স, ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর)। এটাই। কোনও দলই কোনও দলকে মাঠে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েনি। বেশিরভাগ ম্যাচ ছিল আনপ্রেডিক্টেবল। একপেশে ম্যাচ খুবই কম হয়েছে। গ্রুপ লিগে শেষ ম্যাচগুলিতে এমন সমীকরণ ছিল, যা ওই ম্যাচগুলিকে খুবই আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্পেন-জাপান, জার্মানি-কোস্টারিকা ম্যাচ দু’টি একইসময় হচ্ছিল। প্রতিমুহূর্তে গ্রুপ টেবলের চার্ট ওঠা-নামা করছিল। এমন থ্রিলারের সাক্ষী থাকার জন্যই তো বিশ্বের মানুষ চতুর্বর্ষীয় যজ্ঞের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে থাকে। নানা প্রান্ত থেকে ছুটে যায় বিশ্বকাপের রসনাতৃপ্তি পেতে। এককথায়, দশর্ককদের পয়সা উসুল হয়ে গিয়েছে। কোচেদের ট্যাকটিক্সের লড়াই হয়েছে যথেষ্ট উপভোগ্য। এ বিষয়ে নজর কেড়েছেন মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই, সৌদি আরবের কোচ হার্ভে রেনার্ডরা। যারা বিশ্বমঞ্চে তথাকথিত অনামী। কাতার বিশ্বকাপই তাঁদের যোগ্য স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিশ্বকাপ মানেই জন্ম হবে ভবিষ্যতের তারকার। এ অনিবার্য। কাতার বিশ্বকাপের মাধ্যমে বিশ্ব চিনেছে সোফিয়ান আমরাবাত, ভিনসেন্ট আবুবকর (প্রথম আফ্রিকার ফুটবলার হিসাবে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে গোল করে জিতিয়েছেন ক্যামেরুনকে), রিচার্লিসন, জুলিয়েন আলভারেজ, সালেম আল-দাওসারি, এনজো ফার্নান্ডেজ, জসকো গাভারদিয়লদের। একের পর এক দর্শনীয় গোল হয়েছে। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মেক্সিকোর লুইস চাভেজের ফ্রিকিক। যে গোলটি বহু ফুটবলপ্রেমী মানুষ চাক্ষুষ করেননি। পর্তুগালের বিরুদ্ধে সনের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে গোলের ঠিকানা পাস। এমন অনেক আছে। তবে রেফারিং নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় অনেকে। বিশেষত, পেনাল্টির সিদ্ধান্তগুলি বিতর্কিত মনে হয়েছে অনেকের। এছাড়াও কাতার বিশ্বকাপের মাধ্যমে বহু নতুন কিছুর সাক্ষী থেকেছে ফুটবল বিশ্ব। সর্বোপরি বলাই যায়, বিশ্বকাপ বিশ্বকাপের মতোই হয়েছে। রবিবার রাতের পর আবার চার বছরের অপেক্ষায় থাকবেন ফুটবলপ্রেমীরা।
Comments :0