যত দিন যাচ্ছে তত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই, প্রবল তাপে পুড়ে যাচ্ছে খেতের ফসল। শীতকালে প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। গরমের সময় অস্বাভাবিক তাপ। একের পর এক বড় রকমের ঝড় তছনছ করে দিচ্ছে চারদিক। পরিবেশকে কিভাবে বাঁচানো যায় তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা যেমন অনুসন্ধান করছেন তেমনি সারা বিশ্বের নেতারা বসছেন আলোচনায়। মিশরে হলো ‘কোপ ২৭’ পরিবেশ সম্মেলন। সেখানে আলোচনা তো হচ্ছে কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা নিয়ে থাকছে বিস্তর সংশয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাষণ দিচ্ছেন। পরিবেশ রক্ষার কথা বলেন। নদী, নালা, খাল বিল বাঁচানো, সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষা নিয়েও বলে থাকেন। কিন্তু মোদী সরকারের নীতিতেই বিপন্ন হচ্ছে সমুদ্রের প্রাণীরা। সরাসরি প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের রোজগারে।
কেন্দ্রের সাগরমালা প্রকল্পে কর্পোরেট সংস্থার চরম ক্ষতির মুখে পড়ছে সামুদ্রিক প্রাণীরা। বিপন্ন মৎসজীবীরা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র মৎসজীবীরা। প্রথমত বড় বড় জাহাজ থেকে নির্গত তেল দূষিত করবে জলকে। মৃত্যু হবে বহু সামুদ্রিক প্রাণীর। এছাড়াও ১২ নটিকেল মাইলের মধ্যে ক্ষুদ্র মৎসজীবীরা মাছ ধরেন। সাগরমালা প্রকল্পের জন্য তাঁদেরও রুটি রুজি বন্ধ হবে। কারণ কর্পোরেট দখলে চলে যাবে সেই অংশ।
সারা ভারত মৎস্যজীবী ও মৎস্য শ্রমিক ফেডারেশন মোদী সরকারের এই নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছে। সারা ভারত মৎস্যজীবী ও মৎস্য শ্রমিক ফেডারেশনের (AIFFWF) সর্বভারতীয় সভাপতি দেবাশিস বর্মন বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতির ফলে চরম ক্ষতি হবে পরিবেশ ও সামুদ্রিক প্রাণীদের। কর্পোরেটের হাতে চলে গেলে তা কখনই সংরক্ষিত হবে না। বরং তারা মুনাফা লোটারই চেষ্টা করবে। এই নিয়ে সারা দেশের মৎসজীবীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছে। কেরালা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, গোয়া, এদিকে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওডিশা ও পশ্চিমবাংলার উপকূলবর্তী মৎসজীবীরা আন্দোলন সংগঠিত করেছে।’’
বর্মন বলছেন, ‘‘মৎসজীবীরা প্রথমত ছোটো নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যান যাতে মাছ বিরক্ত না হয়। বড় জাহাজের মতো জলে তেলও মেশে না। এছাড়াও বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে মাছের প্রজননের কারণে বন্ধ থাকে মাছ ধরা। সেই সমস্ত নিয়ম ভেঙে যাবে পুঁজিপতিদের হাতে গেলে।’’
সাগরমালার বিরোধিতা করছে ছোট মৎস্যজীবী সংগঠনগুলর মঞ্চ ‘ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর স্মল স্কেল ফিশ ওয়ার্কার্স’। দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ নীতি কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির স্বার্থে পরিবেশ সম্মেলনের সমস্ত সুপারিশকে অগ্রাহ্য করে ভারতের উপকূল এবং সমুদ্র জলসীমা অঞ্চলে অবাধ লুণ্ঠনের নীতি গ্রহণ করেছে।
সিআরজেড (CRZ), এসইজেড (SEZ) সহ সাগরমালা প্রকল্প, ব্লু-রেভূলিউশন বা নীল বিপ্লব নামে পলিসি গ্রহণ করেছে এবং তাকে সুরক্ষিত করতে অবশেষে ২০২১ সালে "সমুদ্র ও উপকূল ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট -২০২১"পাস করেছে তাতে দেশের প্রথাগত ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের এবং মৎস্য সংশ্লিষ্ট সমস্ত ধরনের ক্রিয়াকর্মে যুক্ত দেশের অন্তত ১১টি উপকূলীয় রাজ্যের অন্তত ৩কোটি মানুষের জীবন জীবিকা বিপন্ন হবে।
তবে শুধু ভারত নয় ক্ষতির মুখে পড়বে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিও। অন্তর্দেশীয় অন্তত ১২ কোটির বেশি মৎস্যজীবী ও মৎস্য শ্রমিকে জীবন জীবিকা বিপন্ন হবে। সমুদ্র উপকূলে তারা বংশানুক্রমে যে বাসস্থান গড়ে তুলেছিল তাও চলে যাবে আদানি, আম্বানির মতো কর্পোরেটদের হাতে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে কেন্দ্রের বিজেপির সরকার কিভাবে সমুদ্র উপকূল ও মৎসজীবীদের রুটি রুজি বন্ধ করা যায় তার রূপরেখা এঁকেছিল। ২০১৪ সালের পর মীনাকুমারী কমিশনের সুপারিশের নামে সবগুলি বাতিল করে দিয়েছে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে সমস্ত প্রকল্প এবং আইন গ্রহণ করেছে। নদী-সমুদ্র এমনকি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জলাভূমিতে মৎস্যজীবীদের ও মৎস্য শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত যে সমস্ত আইন এবং কল্যাণমূলক প্রকল্প ছিল সবই বাতিল করে দিয়েছে। দেশজুড়ে উপকূলীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে কোন রকম পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ ছাড়াই।
দেবাশিস বর্মন বলছেন, শুধু বিজেপি নয় আদানিদের হাতে তাজপুর বন্দর তুলে দিয়ে একই চক্রান্ত করছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। তাজপুর থেকে জুনপুট পর্যন্ত নদী বন্দর চলে যাবে আদানিদের হাতে। মৎসজীবীরা ওই জল সীমানায় আর মাছ ধরতে যেতে পারবে না। মাছ ধরা থেকে বিক্রি সবই করবে আদানিরা। শুধু যে মৎসজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাই নয়, উপকূলবর্তী অঞ্চলে থাকা হাজার হাজার মানুষ ভিটে ছাড়া হবেন। জঙ্গল সাফ হয়ে যাবে। তার পরিবর্তে গড়ে উঠবে রিসোর্ট, বিলাসবহুল হোটেল।
Comments :0