Communist Manifesto 175

দুনিয়া বদলের ইশ্‌তেহার

সম্পাদকীয় বিভাগ

দেবাশিস চক্রবর্তী


১৭৫ বছর আগে লেখা কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্‌তেহার যেমন ধ্রুপদী তেমনই সমসাময়িক। ১৮৩০-র দশক থেকেই জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, বেলজিয়ামে একের পর এক শ্রমিক সংগঠন তৈরি হচ্ছিল। এই সংগঠনগুলির কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের কথা বলত, এমনকি কমিউনিজমের কথা বলত। কিন্তু ভবিষ্যতের সমাজ সম্পর্কে এবং শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক কর্তব্য কী হবে তা নিয়ে অস্বচ্ছ ধারণা ছিল। মার্কস-এঙ্গেলস চেষ্টা করছিলেন এই ধরনের সমাজতন্ত্রবাদীদের এক জায়গায় জড়ো করা যায় কি না। ১৮৪৭ সালে কমিউনিস্ট লিগ তৈরি হয়। সে-বছরেররই নভেম্বর- ডিসেম্বরে কমিউনিস্ট লিগের দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়। সেখান থেকে ঠিক হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশ্‌তেহার’ তৈরি করা হবে। পার্টির ইশ্‌তেহার প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও ইউরোপে সেই সময়ে কোনও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল না। ইশ্‌তেহার রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্কসের ওপরে। এঙ্গেলসও সঙ্গে ছিলেন। ততক্ষণে ওঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং রাজনৈতিক চিন্তার গভীর মিল তৈরি হয়ে গেছে। একসঙ্গে বইও লিখে ফেলেছিলেন। বস্তুত এঙ্গেলসের একটি খসড়া ‘প্রিন্সিপালস অব কমিউনিজম’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল যার সঙ্গে ইশ্‌তেহারের প্রচুর মিল।  
চিরউদ্বাস্তু মার্কস কমিউনিস্ট লিগের সদস্য ছিলেন ব্রাসেলস থেকে। জার্মানি থেকে তাড়া খেয়ে তিনি বেলজিয়ামে। ১৮৪৮সালের ২৬ জানুয়ারি লিগের কেন্দ্রীয় কমিটি ব্রাসেলস কমিটির কাছে চিঠি লেখে: ‘নাগরিক মার্কসকে (সিটিজেন মার্কস) ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইশ্‌তেহার জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। তাঁর কাছে থাকা নথিপত্রও ফেরত নিয়ে নেওয়া হবে। 


তাড়ার কারণ ছিল। মার্কস স্বভাবসিদ্ধ দেরি করছিলেন (এক পড়াশোনা থেকে অন্য পড়াশোনায় চলে যেতেন, নিখুঁত করতে চাইতেন)। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানিতে শ্রমিক বিদ্রোহের ঝড় উঠেছিল। তার আগে কমিউনিস্টরা কী চায় পৌঁছাতে পারলে ভালো ছিল। বস্তুত ১৮৪৮-র ফেব্রুয়ারিতে প্যারিসে অভ্যুত্থানের পরে ইশ্‌তেহার সেখানে পৌঁছায়। প্রথম বাক্য: ‘ইউরোপ ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত’। ইশ্‌তেহারে ব্যাখ্যা করা হলো কমিউনিস্টরা আসলে কী চায়। 
ইশ্‌তেহারের বিরাট অংশই শ্রেণি ও শ্রেণির দ্বন্দ্বের ধারণা। গোড়াতেই লেখা হয়েছিল, ‘এ পর্যন্ত প্রচলিত সমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস’। পরে ‘লিখিত’ কথাটি এঙ্গেলস যুক্ত করেছিলেন। ১৮৪৮ পর্যন্ত সামাজিক বিকাশের লিখিত ইতিহাসের ভিত্তিতেই এই কথা বলা হয়েছিল। পরে এ সংক্রান্ত গবেষণায় আদিম সাম্যবাদী সমাজের ইতিহাস সামনে আসে, যা শ্রেণি সংঘাতে পরিপূর্ণ ছিল না। মর্গানের গবেষণা থেকে বিকাশের অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যায়। মার্কস নিজেও ভারত থেকে আয়ারল্যান্ডের পুরানো সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিশেষ উৎপাদন ব্যবস্থার সন্ধান পান। উৎপাদনের হাতিয়ার নিম্নপর্যায়ের হওয়ায় তার ভিত্তিতে শ্রেণি বিভাজন সম্ভব ছিল না। শ্রেণি সংক্রান্ত ধারণাই ইতিহাস সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলসের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি। 
ইতিহাস সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ইশ্‌তেহারে বলা হয়েছিল, ‘‘অত্যাচারী ও অত্যাচারিতরা সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে বিরতিহীন লড়াই চলেছে। হয় তাতে সমাজের বিপ্লবী পুনর্গঠন ঘটেছে অথবা দ্বন্দ্বরত শ্রেণিগুলির অভিন্ন ধ্বংসের মধ্যে পরিণতি ঘটেছে’’। 
মার্কস-এঙ্গেলস শ্রেণি আবিষ্কার করেননি। তাঁদের আগে ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানীরা দেখেছেন। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস যেভাবে সমাজের বিকাশে তাকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিয়েছেন তা আগে কেউ দেয়নি। শ্রেণির কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা তাঁরা দেননি। ক্যাপিটাল তৃতীয় খণ্ডে অংশত রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, মার্কসের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত। কিন্তু তাঁদের রচনায় শ্রেণির কয়েকটি উপাদান তাঁরা স্পষ্টই করে গিয়েছেন। উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা, উৎপাদিত পণ্যের ওপরে অধিকারের ভিত্তিতে নির্ভর করে উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন সম্পর্কেই সামাজিক গোষ্ঠী ও ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থান নির্ধারিত হয়। 


কিন্তু এইটুকু বললেই হবে না। এভাবে শ্রেণিগত অবস্থান স্বয়ংক্রিয় ভাবে তৈরি হচ্ছে। উৎপাদন ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে অন্তর্নিহিত কারণেই তৈরি হওয়া শ্রেণি— পরিভাষায় ‘ক্লাস ইন ইটসেলফ’। শ্রেণি গঠনের প্রক্রিয়া এখানে শেষ হয় না। সমাজে সেই শ্রেণির কী ভূমিকা, সেই বোধ বা চেতনা যুক্ত হলে তা পূর্ণ হয়। বলা হয়, ‘ক্লাস ফর ইটসেলফ’। সাধারণভাবে তা গড়ে ওঠে আরেকটি সামাজিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিন্ন বৈরিতা থেকে। যেমন সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস বললেন,‘ পুঁজির বিরুদ্ধে তারা ইতিমধ্যেই একটি শ্রেণি কিন্তু নিজেদের জন্য বিকশিত হওয়া শ্রেণি এখনও নয়’। শ্রেণি গঠনের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক সংগঠন। সর্বহারার রাজনৈতিক সংগঠন শ্রেণি হিসাবে সর্বহারার গড়ে ওঠার অন্যতম হাতিয়ার।

দুনিয়াকে ঢেলে সাজায় বুর্জোয়ারা 
----------------------------
ইশ্‌তেহারে বলা হয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণি (প্রধানত পুঁজির মালিক) নিজেই অনেক বিবর্তনের ফসল। ক্রমাগত উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ না ঘটিয়ে পুঁজিবাদ টেঁকে না। আগের পদ্ধতিকে ধ্বংস করেই তার বিকাশ। প্রযুক্তির বিকাশের এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গী হয়ে রয়েছে। গত একশো বছরে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ক্রমাগত পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি। বস্তুত প্রতি মূহূর্তেই বিশ্বের কোনও না কোনও প্রান্তে উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। তবে, একসময়ে পুঁজিবাদে একচেটিয়া ব্যবস্থা এসেছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উৎপাদনে কতটা কাজে লাগানো হবে তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মুনাফা তাড়িত পুঁজিবাদ একচেটিয়ার স্তরে না পৌঁছালে প্রযুক্তির বিকাশ আরও হাজার গুণ বেশি হতো। 
ইশ্‌তেহারে বলা হয়েছিল প্রকৃতির শক্তিকে পুঁজি বশে আনছে। পুঁজিবাদের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এটি। প্রকৃতিকে এখন শুধু ‘বশে’ আনাই নয়, মুনাফার স্বার্থে প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে পুঁজি এখন বেপরোয়া। পরিবেশ ধ্বংসের অভিযানে মত্ত। বস্তুত সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম মুখ্য উদ্বেগের বিষয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতির বিপর্যয়, এ গ্রহের বিপন্নতা। নদী-অরণ্য—খনি সবই লুটেরা পুঁজির জবরদখলের কোপে পড়েছে। 
পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অতি উৎপাদনের সঙ্কট। মার্কস-এঙ্গেলস ১৮৩৬-৩৭’র ইউরোপের সঙ্কট দেখেছিলেন। ইশ্‌তেহার লেখার সময়েও ইউরোপে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছিল। তুলো, লোহা, খনিতে সঙ্কট চলছিল। কিন্তু শুধু একটি সঙ্কট নয়, বারংবার ঘুরে আসা সঙ্কট পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত। পুঁজিবাদে অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে না, সেই কারণে পণ্যের চাহিদায় টান পড়ে, অতি উৎপাদনের সঙ্কট তৈরি হয়। এটা ঠিকই যে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার সক্ষমতা তৈরি করতে পারে পুঁজিবাদ। কিন্তু আবারও এক নতুন সঙ্কটের আবর্তে পড়ে যায়। 


ইশ্‌তেহারে স্পষ্টই বলা হয়েছিল পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের প্রবণতার কথা। লেখা হয়েছিল, ‘আধুনিক শ্রমশিল্প প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্ব বাজার’। পণ্য এবং পরে পুঁজির রপ্তানি সংহত বিশ্বমাত্রিক বাজারের প্রসার ঘটায়। পুঁজির যে সঞ্চরণশীলতার কথা পরে ‘ক্যাপিটাল’ —এ আমরা আরও গভীরে পড়ি, তার সব সময়েই একটি বিশ্বজোড়া চেহারা ছিল। ইশ্‌তেহারে লেখা ছিল: ‘নিজেদের তৈরি পণ্যের অবিরাম ক্রমবর্ধমান বাজারের তাগিদ বুর্জোয়াদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। সর্বত্র এদের ঢুঁ মারতে হচ্ছে, সর্বত্র গিয়ে শিকড় গেড়ে বসতে হচ্ছে, সর্বত্র স্থাপন করতে হচ্ছে যোগসূত্র।’ পুঁজিবাদ, বিশেষ করে শিল্প বিপ্লবের স্ফূরণের পর থেকে বিশ্বায়িত উৎপাদন ব্যবস্থা। যে বিশ্বায়নের সর্বব্যাপ্ত চেহারা একবিংশ শতাব্দীতে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদের মধ্যেই তার প্রবণতা অন্তর্নিহিত। ইশ্‌তেহারে বলা হয়েছিল, ‘এটা করতে গিয়ে বুর্জোয়াশ্রেণি প্রত্যেক দেশের উৎপাদন ও পরিভোগকে বিশ্বজনীন চরিত্র দিয়েছে।’ ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য পর্বে বিশ্বায়নের মুখ্য বৈশিষ্ট্য অবশ্যই প্রতিফলিত হচ্ছিল উপনিবেশের মধ্যে দিয়ে। উপনিবেশকে বাদ দিয়ে ইউরোপে সম্পদ চালানো অসম্ভব ছিল। মার্কস তাঁর অন্য রচনায় এবং ‘ক্যাপিটাল’-এ উল্লেখ করেছেন আমেরিকায় ইউরোপের দখলদারির কথা। ভারত সম্পর্কে রচনায় মার্কস দেখিয়েছিলেন কীভাবে ‘ট্রিবিউট’-এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ চালান হচ্ছে ইংল্যান্ডে। ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটি ব্যবহার না করেও মার্কস ‘ক্যাপিটাল’-এ উপনিবেশকে ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের ‘স্বর্ণালি ঊষা’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। 
অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন তো বটেই, ইশ্‌তেহার লিখেছিল, ‘বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের ধাঁচে জগৎটাকেই গড়ে তোলে’। পুঁজির মুনাফা সন্ধানই পুঁজিবাদের যাবতীয় নীতি-নৈতিকতার ভিত্তি। সামাজিক বিধি ও আইনকানুন তৈরি হয়েছে মুনাফা ও সম্পত্তিকে রক্ষা করতে। অসাধারণ শব্দবিন্যাসে ইশ্‌তেহার লিখেছিল, ‘এরা যাকে বলে সভ্যতা— তা গ্রহণ করতে সমস্ত জাতিকে বাধ্য করছে, অর্থাৎ বাধ্য করছে তাদেরও বুর্জোয়া বনতে। এককথায় বলা যায় এরা নিজেদের ছাঁচে দুনিয়াকে ঢেলে সাজাচ্ছে’। এমনকি দেশীয় সাহিত্য কীভাবে বিশ্বসাহিত্য হয়ে উঠছে, তাও লক্ষ্য করেছিল ইশ্‌তেহার। 
এই যে ঢেলে সাজানো, তা অব্যাহত রয়েছে। আজকের দুনিয়ায় আধিপত্য করছে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি। তার মুনাফার অঙ্কই বিশ্ব অর্থনীতির নিয়মকানুনকে পরিচালিত করছে। বিশ্বায়িত পুঁজি কারও সম্মতির অপেক্ষায় বসে নেই, জবরদখলের প্রক্রিয়ায় সে জীবিকা থেকে প্রকৃতি সবই ধ্বংস করছে। গোটা পৃথিবীতে মূলগতভাবে একই অর্থনৈতিক নিয়মনীতি যেমন রূপায়িত হচ্ছে তেমন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৈতিক কাঠামোও সমধর্মী করে তোলা হচ্ছে। ‘ছাঁচ’ এখন আরও প্রকট— খাদ্য থেকে পোশাক, বিনোদন থেকে বিতর্কে। 


মধ্যবর্তী শ্রেণি 
---------------
ইশ্‌তেহারে বলা ছিলো, ‘মূলত দুই শ্রেণি’। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শ্রেণী। পুঁজির মালিক, জমির মালিক, সর্বহারাদের প্রসঙ্গেই বিশদ আলোচনা রয়েছে। তা থেকে অনেকে বলেন মার্কস মধ্যবিত্তদের উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু মার্কস নিজেই লক্ষ্য করেছিলেন, ‘মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে, যারা একদিকে শ্রমিক অন্যদিকে পুঁজির মালিক এবং জমির মালিকের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে’। 
মধ্যবিত্ত সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘‘আধুনিক সমাজের স্বাধীন বর্গ হিসাবে তারা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হবে’’। এই পর্যবেক্ষণ নিয়েও বহু আলোচনা হয়ে থাকে। লক্ষণীয়ভাবে ‘স্বাধীন বর্গ হিসাবে’ কথাটি ব্যবহার হয়েছিল। পুঁজির ওপরে নির্ভরশীল হয়েই মধ্যবিত্তকে টিঁকে থাকতে হয়েছে, এ কিন্তু সত্য। পুঁজির গতিপ্রকৃতি, পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির ওঠাপড়া মধ্যবিত্তকে ভেঙেছে-গড়েছে। তবে, মধ্যবিত্ত অবলুপ্ত হয়নি। ‘মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলির’ ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাবার একটি প্রবণতার ইঙ্গিত ইশ্‌তেহারে ছিল বটে। মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। বরং সমসাময়িক সমাজে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। তা থেকে অনেকে তত্ত্বায়ন করেন যে আজকের সমাজ মধ্যবিত্তের সমাজ। পুঁজি বনাম শ্রমের পুরানো দ্বন্দ্ব নেই। অথচ মধ্যবিত্তের অধিকাংশ পেশাই কিন্তু পুঁজির ওপরে গুরুতর রকমের নির্ভরশীল। বিশেষ করে এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ক্ষেত্র, বিনোদন, তথ্য প্রযুক্তিতে বেসরকারি বড় পুঁজির অবাধ দাপট। এইসব ক্ষেত্রে কর্মরত পেশাদার, মধ্যবিত্তের পুঁজির ওপরে নির্ভরশীলতা স্পষ্টই। আরেকটি প্রশ্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে পুঁজির অন্তর্নিহিত সম্পর্ক। ইশ্‌তেহারে এই সম্পর্কটির কথা আকর্ষণীয় শব্দবন্ধে (ম্যানেজিং কমিটি) বলা হয়েছিল; রাষ্ট্র পরিচালনার প্রকৃত কাঠামোটি তা থেকে জটিলতর। ক্রমে তা আরও জটিলতর চেহারা নিয়েছে। কিন্তু পুঁজির মালিকরা যে রাষ্ট্রের মূল নীতিসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই। 
ইশ্‌তেহার যখন লেখা হচ্ছে তখন মার্কস-এঙ্গেলসের নিজেদের ভাষাতেই বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যের শতবর্ষও পূর্ণ হয়নি। সেই সময়ের পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোয় মধ্যবিত্তেরই উল্লেখযোগ্য অংশকে বুদ্ধিজীবী বা ইন্টেলেকচুয়ালদের ‘বুর্জোয়াদের পয়সা পাওয়া মজুরি শ্রমিক’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। যে অর্থে শ্রমিকশ্রেণি মজুরি দাসত্বে থাকে, সেই অর্থে নয়। মার্কসের অন্য অনেক লেখাতেই বুর্জোয়াদের মতাদর্শগত প্রতিনিধি, মুখপাত্র হিসাবে এই বর্গকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মার্কস দেখেছিলেন শ্রেণি সমাজ সম্পর্কে মোহ নিখুঁত করে তোলাই এদের জীবিকার প্রধান উৎস। এই কাজ পুঁজির মালিক নিজে যতটা করে, তার থেকে বেশি করে সমাজের উপরিকাঠামোতে যুক্ত বুদ্ধিবৃত্তির জগতের মানুষ। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এ কথা মূলগতভাবে সত্য ছিল; এখনও তেমন অসত্য নয়। 
অনেক সময়ে এই অংশকে ‘মতাদর্শগত শ্রেণি’ বলেও উল্লেখ করেছেন মার্কস। স্পষ্টই উল্লেখ করেছিলেন শ্রেণি ভিত্তি যাই হোক না কেন কোনও কোনও বুদ্ধিজীবী বস্তুনিষ্ঠভাবে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। কেউ বলবেন, মার্কস নিজেই ছিলেন এমন এক বুদ্ধিজীবী যিনি সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে সর্বহারার লড়াই লড়েছেন আজীবন। ইতালির মার্কসবাদী নেতা আন্তোনিও গ্রামসি বুদ্ধিজীবীদের ‘চিরাচরিত’ (ট্র্যাডিশনাল) এবং ‘জনতার মধ্যে সক্রিয়’ ( অর্গ্যানিক) এই দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন। গ্রামসি ‘অর্গ্যানিক’ বলতে তাঁদের বোঝাতেন যাঁরা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মর্মবস্তু উপলব্ধি করতে পারেন, শ্রমজীবীর পাশে দাঁড়াতে পারেন।

যে শ্রেণি মুক্তি দিতে পারে
-----------
সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতই ইশ্‌তেহারের মূল শ্রেণি। এই অর্থে যে তাদের ওপরেই ইতিহাসের ভবিষ্যতের গতি নির্ভর করছে। ‘বুর্জোয়াশ্রেণি শুধু নিজেই নিজের মৃত্যুর অস্ত্র বানিয়েছে তা নয়, যে মানুষ এই অস্ত্র চালাবে , সেই আধুনিক শ্রমিক শ্রেণিকে— প্রলেতারিয়েতকে সৃষ্টি করেছে’— এইভাবেই বলা ছিল ইশ্‌তেহারে, ভবিষ্যতের সঙ্গেই শ্রেণি হিসাবে সর্বহারার ভূমিকাকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। প্রলেতারিয়েত কোনো অখণ্ড, অনড়, শাশ্বত সত্তা নয়। ইশ্‌তেহারেই বলা হয়েছিল, ‘বিকাশের নানা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে প্রলেতারিয়েতকে যেতে হয়’। শোষণের একটি মাত্র রূপই নেই। ‘ক্যাপিটাল’ প্রথম খণ্ডের সংযোজনীতে বলা হয়েছে, শ্রম প্রক্রিয়ার বিভিন্ন রূপে সর্বহারারও বিভিন্ন রূপ। কেউ হাতে, কেউ মস্তিষ্কে, কেউ হীনবৃত্তিতে যুক্ত। এই বিশ্লেষণ আজকের সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক-ঐতিহাসিক ভূমিকাকেই অস্বীকার করার তাত্ত্বিক প্রবণতা কাজ করছে। মার্কস—এঙ্গেলসের রচনা থেকে স্পষ্ট হয় মালিক শ্রেণির সঙ্গে শ্রমশক্তি বিক্রির সম্পর্ক, উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরির সম্পর্কে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থান বাঁধা। তা শুধুমাত্র কারখানায় কালিঝুলি মাখা শ্রমিকই নয়, শোষিত সর্বহারার রূপে বদল ঘটবে। কেবল বস্তুগত পণ্য উৎপাদনই নয়, মেধা ও জ্ঞানের জগতে পণ্য উৎপাদনও এর অন্তর্ভুক্ত। 
আমাদের সময়ের পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য অসংগঠিত ক্ষেত্র। সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের বদলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার হচ্ছে, এমনকি সংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যেও ঠিকা-অস্থায়ী-চুক্তি শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু প্রযুক্তির বিকাশের কারণেই তা হয়েছে, এমন নয়। শ্রমিকশ্রেণির সংগঠিত অধিকার, দর কষাকষির ক্ষমতা খর্ব করার জন্যও উৎপাদন পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুঁজি বনাম শ্রমের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে এই ঘটনাকে উপলব্ধি করা যাবে না। তেমনই মেধা শ্রমিক, জ্ঞানের জগতে কর্মরতদের পুঁজির শোষণের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। বস্তুত ‘নলেজ প্রলেতারিয়েত’ শব্দটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে চলে এসেছে। 
শুধু বিশ্লেষণই নয়, আসল কথা হলো রূপান্তর। কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার থেকে পরবর্তী রচনায় কেন্দ্রবিন্দুতে বিপ্লব— সর্বহারা যার নেতা। ইতিহাসের ‘চালিকা শক্তি’ হিসাবে বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের পার্থক্য। প্রাক সর্বহারা বিপ্লব ইতিহাসের বিপ্লবসমূহ ছিল মূলত রাজনৈতিক। রাষ্ট্রের নীতি ও জনসাধারণের বাস্তব জীবনের মধ্যে পার্থক্য ঘটে যেত। সর্বহারা বিপ্লবের চরিত্র হবে শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক। ইশ্‌তেহারে বলা হয়েছে, অতীতের সমস্ত ঐতিহাসিক আন্দোলন (বিপ্লবী রূপান্তরের অর্থেই) ছিল সংখ্যালঘুদের আন্দোলন। প্রলেতারীয় বিপ্লবই হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মসচেতন স্বাধীন আন্দোলন। প্রলেতারিয়েত ‘সরকারি সমাজের গোটা স্তরকে’ ছুঁড়ে না ফেলে নিজে দাঁড়াতে পারে না। তাই এই বিপ্লব সামাজিক কাঠামোর আমূল রূপান্তর। 
ইশ্‌তেহারের আগেই ‘হোলি ফ্যামিলি’-তে মার্কস-এঙ্গেলস উত্তর দিয়েছিলেন প্রলেতারিয়েতকে কেন সামাজিক রূপান্তরের অগ্রণী শক্তির অভিধা দেওয়া হচ্ছে। কেন ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভূমিকা’ পালনের জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছে? সর্বহারা কি খুব বীর, সাহসী, উন্নত নীতি-নৈতিকতায় ভরপুর এবং সব সময়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত বলে? বস্তুত শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে চলমান সমাজের যাবতীয় দোষ ও বিকৃতির প্রতিফলনও পাওয়া যায়। ‘এই কারণে নয় যে প্রলেতারিয়েতকে ঈশ্বর বলে মনে করা হয়, বরং ঠিক তার বিপরীত’। প্রলেতারিয়েত হলো আধুনিক সমাজে মানুষের সবচেয়ে বিমূর্ত রূপ, প্রকৃত জীবন তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। প্রলেতারিয়েত রূপের মধ্যে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ বলতে যা বোঝানো উচিত, তা প্রলেতারিয়েতের মধ্যে হারিয়ে গেছে। প্রলেতারিয়েতের জীবন হলো আধুনিক জীবনের সবচেয়ে অমানবিক রূপ। জীবনের সমস্ত প্রকৃত অর্থ কেড়ে নেওয়ার এই প্রক্রিয়া এখন পরিস্ফুট, একে আর কোনও ছদ্মবেশেই আড়াল করা যাচ্ছে না। প্রলেতারিয়েতের জীবনের চাহিদা আর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্ক নিত্য সংঘাতে লিপ্ত হয়ে গেছে। প্রলেতারিয়েতের পক্ষে এই ব্যবস্থাকে ভেঙে না ফেলে নিজেকে মুক্ত করার অন্য কোনও পথই নেই। পুঁজিবাদকে না ভেঙে তার কোনও উপায়ই নেই বলেই এই ব্যবস্থাকে নির্মমতম আঘাত দিতে পারে সে-ই। 


শাসক শ্রেণিকে উৎখাতের এই প্রক্রিয়ায় সর্বহারা শ্রেণিরও বিপুল রূপান্তর ঘটে। যুগযুগান্তের কাদা মুছে নতুন সমাজের যোগ্য হয়ে ওঠে এই শ্রেণি। বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে গড়ে ওঠার অনিবার্য উপাদান হলো শ্রেণি চেতনা, যার কথা আমরা আগেই বলেছি। এই চেতনা কেবল স্বতোৎসারিত হতে পারে না, বাইরে থেকে নিয়ে যেতে হয়। রাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্বই প্রধান। 
ইশ্‌তেহার লেখার সময়ে অন্যান্য শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজতন্ত্রী ধারার সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচ্ছেদই ছিল। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস পরে জানিয়েছিলেন পরিস্থিতির বদল ঘটেছে, ওই অংশটি আর তেমন প্রাসঙ্গিক নেই। কিন্তু কমিউনিস্টরা কেন অন্য শ্রমিক আন্দোলন থেকে পৃথক? দুটি বিষয় ইশ্‌তেহারে খুবই স্পষ্ট। এক, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমগ্র সর্বহারার অভিন্ন স্বার্থকে তারা সামনে নিয়ে আসে। জাতীয় সংগ্রামের মধ্যেই তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। ইশ্‌তেহার শেষ হয়েছে সেই ধ্বনিতেই: দুনিয়ার মজদুর এক হও। দুই, ‘শ্রমিক শ্রেণির আশু লক্ষ্য অর্জনের জন্য কমিউনিস্টরা লড়াই করে কিন্তু বর্তমান আন্দোলনের মধ্যেই তারা আন্দোলনের ভবিষ্যতেরও প্রতিনিধিত্ব করে, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও সজাগ থাকে।’

 

Comments :0

Login to leave a comment