একুশ বছর পর আন্তর্জাতিক ট্রফি। রবিবার রাত ন’টা পঁয়ত্রিশ। কলকাতা বিমানবন্দরে লাল–হলুদ বিস্ফোরণ। লাল হলুদ ধোয়ায় ভাসল বিমানবন্দর চত্বর। গগনভেদী চিৎকারে কাঁপল। শীতের কনকনে হাওয়াকে হার মানিয়ে ইতিহাস ফিরল—ইস্টবেঙ্গলের বীরাঙ্গনাদের হাত ধরে।
সমর্থকদের মুখে মুখে ধ্বনি অ্যান্থনি, ফাজিলাদের নামে। এমন আবহে বিমানবন্দরের ৪এ গেট থেকে বেরোতেই বিস্ময়ের ঝিলিক ফাজিলা, সৌম্যাদের চোখে-মুখে।
ট্রফি হাতে হাজার ওয়াটের হাসি নিয়ে চিত্রগ্রাহকদের সামনে পোজ দিলেন ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের কারিগর। কোচ অ্যান্থনিকে দেখতে পেয়েই, কাছে টেনে নিয়ে উষ্ণ আলিঙ্গন লাল হলুদ অনুরাগীদের। তিনিও সমর্থকদের নিরাশ করলেন না। খেতাব দেখিয়ে বললেন, ‘এই ট্রফির ভাগীদার আপনারও।’ কোচ অ্যান্থনির মুখে ঠিকরে বেরোচ্ছে গর্বের হাসি। গণশক্তিকে তিনি বললেন, ‘আমি অভিভূত। সমর্থকদের এই অভ্যর্থনা পেয়ে খুব খুব ভালো লাগছে।’
প্রতিযোগিতায় নয় গোল করা ফাজিলা ইকওয়াপুট বাসে ওঠার আগে গণশক্তিকে বলে গেলেন, ‘এত সমর্থক দেখে আমি বিস্মিত। ভাবতে পারিনি এত রাতে বিমানবন্দরে এত সমর্থক এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানাবে। এই সমর্থনই আমাদের আরও ভালো খেলতে আরও উৎসাহ দেবে।’
মাঠে গোল করার ক্ষেত্রে যতটা নির্দয় ফাজিলা। মাঠের বাইরে তিনি পুরো অন্য মানুষ। পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য তাঁর মন কাঁদে। তাঁর দেশের বাচ্চারা যাতে খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারে-সেই কারণে তিনি গত ছয় বছর ধরে একটি এনজিও চালান নিজের নামে। সাফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে প্রাপ্ত অর্থ তুলে দিয়েছেন এনজিও’তে। বাসের মধ্যে থেকে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে বিমানবন্দর ছাড়লেন ফাজিলা।
অ্যান্থনি প্রশিক্ষণ তো ছিলই, সেইসঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে বাইচুং ভুটিয়ার ভোকাল টনিক ট্রফি জয়ের খিদে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। খবর নিয়ে জানা গেল, ম্যাচের আগে বাইচুং জুম কলে মোটিভেট করেছেন ফুটবলারদের। সুস্মিতাদের বাইচুং বলেছিলেন, ‘তোমরাই বাংলার ফুটবলের বাহক। চাপ নিও না। মাথা ঠান্ডা রাখো। ট্রফি জেতানোর জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দাও।’ যার ফল- দীর্ঘ ২১ বছর পর বিদেশের মাটিতে মশাল জ্বলল ফের।
২৪ ঘণ্টা পর কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরলেন লাল হলুদের প্রমীলা বাহিনী। ফাজিলা, সুস্মিতা, সুলাঞ্জনাদের আসার প্রায় দু’ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দরের বাইরে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন সমর্থকেরা। সংখ্যায় খুব বেশি নয়— তিনশোর কাছাকাছি। কিন্তু আবেগে, গলায় জোরে, বিশ্বাসে—তাঁরা ছিলেন অগণিত। শীতের বাতাসে লাল-হলুদ পতাকা সদর্পে উড়ল ৪এ গেটের কাছে।গানের তালে তালে ফুলেছে গলার শিরা। দীর্ঘদিনের হতাশা, আক্ষেপ আর না-পাওয়ার জমাট বরফ গলিয়ে দিয়েছে মেয়েদের এই সাফল্য। ফাজিলা, সিল্কি দেবীদের আসার সময় যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে চিৎকার-‘ইস্টবেঙ্গল! ইস্টবেঙ্গল’। শুধু ক্লাবের নামে ধ্বনি নয়, মহিলা দলের কোচ অ্যান্থনি, ফাজিলাদের নিয়েও গান গাইলেন তাঁরা।
২০০৪ সালে কাঠমান্ডুতে সান ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট জিতে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেছিলেন আলভিটো, বাইচুংরা। সেই স্মৃতি এখনও বহু সমর্থকের চোখে ভাসে। রবিবার রাতে সেই ইতিহাস যেন একটু অন্য রূপে ফিরে এল—পুরুষদের নয়, নারীদের হাত ধরে। তবুও এই উদযাপনের মাঝেও চোখে পড়ল অদ্ভুত বৈপরীত্য।
পুরুষ দলের পরপর ব্যর্থতা, সুপার কাপ ফাইনালে হারের ক্ষত এখনও টাটকা। সেই ক্ষতে কিছুটা হলেও প্রলেপ দিয়েছে মেয়েদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সাফল্যের প্রাপ্য সম্মান কি তারা পেল?
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঠিক পরের দিন, ছুটির দিনেও, সুস্মিতা–সুলাঞ্জনাদের বরণ করতে এলেন মাত্র তিনশো জন সমর্থক। সংখ্যাটা কাঁটার মতো বিঁধে যায়। মেয়েদের সাফল্য বলেই কি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া? টালিগঞ্জ থেকে আসা বছর তেরোর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক জিনিয়া দেবনাথ বললেন, ‘ইস্টবেঙ্গল মহিলাদের সাফল্য আমাদের গর্বিত করেছে। ভারতীয় ফুটবলের অন্ধকার অবস্থায় আমাদের দল শুধু বাংলার নয়, গোটা ভারতকে আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে আশা করেছিলাম, পুরুষ দলের মতো মহিলা দলকে অভ্যর্থনা জানাতে আরও বেশি সংখ্যক সমর্থক আসবে!?’ ফাজিলারা ট্রফি জিতে ফিরেছেন শুধু একটি কাপ নিয়ে নয়—তাঁরা ফিরেছেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, জয়ের লিঙ্গ হয় না।
প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুরে দুটোয় ক্লাব তাবুতে পতাকা উত্তোলন। একদিনের বিশ্রামের পর, আইডব্লিউএলে’র প্রস্তুতিতে নেমে পড়বে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা।
East Bengal Women
আরও ভালো খেলার প্রেরণা জোগাবে: ফাজিলা অভিভূত অ্যান্থনি
×
Comments :0