লীলা পুরকায়স্থ
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাস যোগ্য করে যাব আমি— নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
যে মানব প্রেমিক কবিরা মানুষের দ্বারা মানুষের উৎপীড়ন অবলোকন করে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন সমাজে একশ্রেণির মানুষের শোষণ যে ভাবে অমানবিক কাজ করে লোভের ও লালসার তৃপ্তি সাধন করে অন্য মানুষকে লাঞ্ছিত করছে, তাদের ক্ষুধার অন্ন কেড়ে নিচ্ছে তাদেরকে চিহ্নিত করে, নিশ্চিত করে নতুন সমাজ গড়ে তোলার সঙ্কল্প গ্রহণ করতে হবে তাঁদেরই, যাঁরা মানবিক কল্যাণে নিয়োজিত প্রাণ। তাঁরাই সেই আহ্বানকে জীবনের পবিত্রতম ব্রত করে সেই লোভী, স্বার্থান্বেষী মানুষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সংগঠিত করাই হবে একমাত্র লক্ষ্য।
আজকে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ এবং মানুষের মধ্যে সর্বাত্মক বিভাজন সৃষ্টি করে দুর্বিসহ যে অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে তা কোনো মতেই সভ্য জগতে চলতে পারে না।
সমাজে কীভাবে রূপান্তর ঘটেছে কার্ল মার্কস তাঁর বিভিন্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিষ্কার করে চিহ্নিত করেছেন। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়ে সমাজের এই পরিবর্তনের মূলে যে পুঁজির ভূমিকা তা অত্যন্ত নির্ভুল ভাবে মার্কস তাঁর ক্যাপিট্যাল-এ লিপিবদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্রের শাসকদের সাহায্যে ও মাধ্যমে কিভাবে সমাজ এক স্তর থেকে অন্য স্তরে পরিবর্তিত হচ্ছে যা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভারতবর্ষ তার ব্যতিক্রমী নয়।
আমরা প্রত্যক্ষ করছি, পুঁজি কিভাবে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মাত্র কয়েকজন ধনকুবেরের হাতে। সেই পুঁজিকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে পুঁজিবাদীদের পছন্দমত পুতুল সরকার। সেই সরকারই গঠিত হবে যে সরকার পুঁজিপতিদের রক্ষা করার জন্য পুতুলের মত তারা যেদিকে দড়ি টানবে সেদিকেই চলতে বাধ্য থাকবে। পুঁজিপতিদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে কোনো কাজ করার ক্ষমতা এদের থাকবে না। এ দেশেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের সাহায্যে যে সরকার গড়া হয়েছে, পুতুল সরকার নানা কৌশল অবলম্বন করে ঐ সরকারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। ঐ পুতুল সরকার দায়বদ্ধ পুঁজিপতিদের কাছে। জনগণের জন্য নয়। প্রথমেই আমরা দেখতে পাব যে, যে সমস্ত কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় আসীন থেকে পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা যায় এবং তা সম্ভব হবে তাদের পরিকল্পিত কৌশল যেন কোনো ভাবেই মানুষ বুঝতে না পারে, সেজন্য শিক্ষার আলো থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে, যে শিক্ষা মানুষের মধ্যে চেতনার উন্মেষ ঘটায় সেই শিক্ষা যেন কোনমতেই তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারে। এমনই সেই কৌশল যা কোনো ভাবেই যেন ঐ পুতুল শাসকদের উদ্দেশ্য ও স্বরূপ উপলব্ধি না করতে পারে। এই অজ্ঞানতা ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনৈক্য গড়ে তুলতে হবে। মানুষ যাতে কোনো মতেই সংঘবদ্ধ হতে না পারে অনবরত নানা কৌশলে মানুষের ঐক্যে ভাঙন জারি করে রাখতে হবে। সেই কারণেই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের জনগণকে নানা অছিলায় একে অন্যের কাছে যেতে দেওয়া যাবে না। ভারতবর্ষের একপ্রাণ এক জাতি একতার ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিতে হবে। নানা ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ এবং অন্য ধর্মের অনুসারী মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ জিইয়ে রাখতে হবে। ভারতীয় সংবিধানে প্রত্যেক ধর্মের মানুষের নিজস্ব ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ও অধিকার স্বীকৃত। তা যাতে অজ্ঞতার কারণে মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে না পারে সেজন্যই তাদের শিক্ষার আলো থেকে দূরে রাখার কৌশল করা জরুরি। নানাভাষা, নানামত, নানা পরিধান—এই বিভিন্নতার মধ্যে যে ঐক্যের সুর তা বিনষ্ট করার জন্য তাদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা দরকার।
কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন, কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’’— কোনো মতেই এই সত্য যাতে মানুষ গ্রহণ না করে সেজন্যই ভারতের নানা স্থানে, নানা প্রচেষ্টায় দাঙ্গা জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা। তাদের এই কৌশল যাতে কার্যকরী না হয়, মানুষের মধ্যে সে চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য সংগঠিত প্রয়াস পরিকল্পিতভাবে করতে হবে, সংগঠিতভাবে চেষ্টা করতে হবে যে যাদের কৌশলে এরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেই সুযোগে অনৈক্য সৃষ্টি করে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার জন্য গঠিত পুতুল সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনসমক্ষে উদ্ঘাটন করে দেওয়া জরুরি। কু-সংস্কারগ্রস্ত মানুষকে মুক্ত চিন্তার বাতাবরণে এক সূত্রে বেঁধে দিতে হবে।
আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি পুঁজিপতিদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভারত সরকার রাতারাতি সরকারি লাভজনক সংস্থাগুলিকে বেসরকারিকরণ করছে। বেসরকারিকরণের সুযোগে নতুন মালিকানায় যাতে লভ্যাংশ তুলে দেওয়া যায়, পুতুল সরকার সেভাবেই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। শোষণের দণ্ড নিয়ে পুঁজিপতিরা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছে।
আর একটি কৌশল এই সরকার একই উদ্দেশ্যে অবলম্বন করছে, নানা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে জনমনে ‘আচ্ছা দিনে’র স্বপ্ন জাগানো। এ যে কত বড় প্রবঞ্চনা তা যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে তার জন্য কৌশলী প্রচার। লক্ষ লক্ষ যুবকের চাকুরি পাবার হাতছানি যাতে তারা গ্রহণ করে তা প্রচার করার নির্দেশ সমস্ত সংবাদমাধ্যমে দিয়ে প্রলোভন দিয়েই চলেছে। যা ভিত্তিহীন।
অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে সুস্থ সংস্কৃতির বদলে নানারকম অপসংস্কৃতির অবতারণা। কোনো প্রগতিশীল সঙ্গীত বা নাটক যাতে প্রচারিত না হয় তার জন্য বিধিনিষেধ জারি। ভারতবর্ষের জরুরি অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণ করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের গান পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে বিনোদনের নামে যে প্রক্রিয়া চলছে যা সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে যুব সমাজকে সুস্থ মানসিকতা থেকে দূরে রাখা যায়। সমাজভাবনা যাতে তাদের মনকে নাড়া দিতে না পারে একই উদ্দেশ্যে তার অবতারণা।
মদ্যপান বা হরেকরকম নেশার উপাদান সহজপ্রাপ্ত করে একদিকে রাজকোষে অর্থসংগ্রহ করা হয়, অন্যদিকে একটা প্রজন্মকে নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখা। চিন্তাশক্তিকে বিপথে পরিচালনার জন্য ভাবনা চিন্তা করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে এবং দেশ কোন পথে যাচ্ছে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তার শক্তি ও হারিয়ে ফেলে।
ইতিহাসকে বিকৃত করার ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কাদের রক্তের ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে তার সঠিক তথ্যকে কোনো মতেই তুলে ধরা হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তকে সেই সংগ্রামীদের পরিচয় করলে, দেশকে জানার ও দেশকে ভালবাসার প্রেরণা জাগানো যেত। শিশুকাল থেকে দেশকে ভালবাসার যে আবেগ, তা বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে মেলে না।
সামাজিক সুরক্ষার দিক বিচার করলে দেখা যাবে মানুষের জীবনের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা আজ সত্যই বিপন্ন। যখন যাকে খুশি খুন করলেও তার কোনো প্রতিকার হয় না। শাসক দলের ‘গুডবুক’-এ থাকলে অনেক বড় অপরাধীও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে এবং সমাজের বুকে অনায়াসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে অবস্থা আমরা বর্তমানে চাক্ষুস করছি তা ফ্যাসিবাদকেও অতিক্রম করে যাচ্ছে। যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোনো সময়ে গরাদের ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই তো আজকের ভারতবর্ষ। বিচারের বাণী নিত্যদিনই ‘নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
বুদ্ধিজীবীরা নানা কারণে উচ্চস্বরে কথা বলতে ভয় পান। আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র বুদ্ধিজীবীদের উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, তাঁদের উপলব্ধিতে সমাজের অবস্থা ও ব্যবস্থার সবকিছুই ছিল। কিন্তু সামাজিক ও রাজার অত্যাচারের ভয়ে সোচ্চার হবার মত অনেক ক্ষেত্রেই মুখবন্ধ করে রাখতেন। কিন্তু অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী চাওয়া পাওয়ার প্রত্যাশা না করে স্পষ্ট কথা বলেন। এর ফলে রাজরোষ তাঁদের ওপর পড়বে। তাঁরা সোচ্চার হয়ে বলেন, মুক্ত চিন্তার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। গলাটিপে সেই মুক্তভাবনাকে রুদ্ধ করার যতই চেষ্টা হোক তাঁরা সোচ্চারেই মুক্তচিন্তার সপক্ষে কথা বলেন।
বিজ্ঞান প্রযুক্তির কথা বহু আলোচিত। নতুন প্রযুক্তির পথে যতই বাধা আসুক সে যুগে গণেশ ঠাকুরের শরীরে অস্ত্রোপচার করার গল্পদ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকছেন না। বিজ্ঞানের গবেষণা ও অগ্রগতি বন্ধ করে দেবার প্রয়াসকে বিজ্ঞানীরা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে মহিলাদের ওপর যে নির্মম ঘৃণ্য অত্যাচার সংঘটিত হচ্ছে তার তুলনা বোধহয় সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শাসক গোষ্ঠীর মদতে নারী নির্যাতনের যে ছবি আমরা দেখতে পাই তার নিন্দার ভাষাও বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে। নারীর অধিকার সুরক্ষার কথা অনেকেই বাতানুকূল ঘরে বসে আলোচনা করেন কিন্তু আজ পর্যন্ত বাস্তবে তার কোনও সুরাহা হচ্ছে না। সমাজের প্রগতি নারীদের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে রাখলে কোনওদিনই সম্ভব হবে না। নারীদের অন্তঃপুরচারিণী করে রাখার সাংঘাতিক চক্রান্ত চলছে। নারীদের শিক্ষা যে কত জরুরি সমাজকে অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে হলে তা সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। নারীরা শিক্ষিত হলে শাসকদের স্বরূপ উদঘাটিত করা অনেক সহজ হত। মানুষের মর্যাদাই নারীদের অধিকার। সামন্ততন্ত্রের পরিবারে নারীকে মহিয়সী রূপে সাজিয়ে রাখা হত, স্বামীর উপযুক্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু জনসংখ্যার অর্ধেক যে নারী সেই নারীকে ‘আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার’ এই বোধ জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব তাঁদের যাঁরা সমাজ সচেতন বা সমাজের মূলস্রোতে নারীকে মানবিকসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম আন্দোলন করছেন। নারীরাই বিশেষভাবে নিরক্ষরতার শিক্ষার। সমাজের তথাকথিত উচ্চমঞ্চে আসীন পুঁজিপতিরা পরিকল্পিতভাবেই নারী প্রগতির পথ রুদ্ধ করে রাখছে। সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যা যে নারী তারা সচেতনতা অর্জন করলে বা সমাজে তাদের ভূমিকা কি তা উপলব্ধি করতে পারলে সমাজ প্রগতি দ্রুততার সঙ্গেই করা সম্ভব হবে।
বর্তমান ভারত সরকার জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষকে অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আবৃত করে রাখার বহুবিধ প্রচেষ্টা করছে। আলোকোজ্জ্বল সুস্থ স্বাভাবিক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে রাখার পরিকল্পনা থেকেই তাদের অন্তঃপুর চারিণী করার চক্রান্ত চলছে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন এবং অন্য মনীষীদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করে নারী শিক্ষার অগ্রগতি বন্ধ করে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার নারীসমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হচ্ছে — এতে লাভবান হচ্ছে ঐ পুঞ্জিভূত পুঁজির অধিকারীরা।
তবে ইতিহাসের রথচক্রে নিশ্চিতভাবেই ঐ স্বার্থান্বেষীদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। সবাই একসঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। শেষ কথা তারাই বলবে যারা পৃথিবীতে মানুষের মতো বেঁচে থাকার মতো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন গড়ে তুলবে — এবং যা অনিবার্য।
Comments :0