‘‘সিপিএম-র একটা ভোট ব্যাঙ্ক আছে এখানে। শুধু এখানে কেন, যেখানে যেখানে ওরা আছে, সেখানেই আছে। আপনি তো কলকাতার লোক। আপনি জানবেন। এখানেও আছে। আমরা সেই ভোট ব্যাঙ্কটা ভাঙানোর চেষ্টা করছি।’’
সাফ স্বীকার করলেন নির্মল মজুমদার।
৫৭ বছরের এই অবসর নেওয়া সরকারি চাকুরে ত্রিপুরার মজলিশপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। তাঁর লক্ষ্য বিজেপি-র ভোট ‘ভাঙানো’ নয়! ‘সিপিএম-র ভোট ভাঙানো। তাঁর বক্তব্য,‘‘বিজেপি-র হাল খারাপ। কথার কথা নয়। ঘুরে দেখুন। কাজ নেই। কোনও প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। মানুষের খুব রাগ।’’
সেই ‘মানুষের রাগ’-কে যতদূর সম্ভব ভাগ করে দিতেই ত্রিপুরায় ২৮টি কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।
তৃণমূলের এই বিজেপি-কে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটি আরও স্পষ্ট করলেন জয়দাল হোসেন। বক্সানগর কেন্দ্রের তিনি তৃণমূলের প্রার্থী। ‘আমি বরাবর বামপন্থীদের বিরোধী’ — নিজের এই পরিচয়টি তিনি জোরের সঙ্গে বলেন। তাই ২০১৭-র এপ্রিলে সদলবলে বিজেপি-তে চলে গেছিলেন বলে রবিবার জানালেন। হয়েছিলেন বিজেপি-র মণ্ডল সভাপতিও। এখন তিনি তৃণমূলের প্রার্থী। তিনি জানালেন,‘‘আমাদের কেন্দ্রে ৪২,০০০ভোট। তার মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আছেন ১৪,০০০। মুসলমান আছে ৪২,০০০। আর উপজাতি আছে ২৫০০। গতবারও এই কেন্দ্রে সিপিএম ৮৪০০ ভোটে জিতেছিল। ফলে সিপিএম-র একটি চান্স আছে। তবে আমি নিজে মুসলমান। আমি দাঁড়িয়েছি। কংগ্রেস, বিজেপি করেছি আগে। লোকে চেনে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় ভোট বিজেপি পেলেও তাদের পক্ষে এখানে জেতা কঠিন।’’ কিন্তু আপনার হিসাবেই তো আপনি দাঁড়ানোয় মুসলমানদের একাংশ আপনাকে ভোট দেবেন। সেই আশাতেই তো আপনি দাঁড়িয়েছেন। তাহলে তো বিজেপি-রই লাভ? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই বিজেপি-র প্রাক্তন নেতা, বর্তমানে তৃণমূলের প্রার্থী হোঁচট খেলেন। এবার বলতে শুরু করলেন নানা দলের ক্ষোভের কথা। যেগুলি আসল অঙ্কই নয়।
আসলে অঙ্ক — যেখানে বিজেপি বিপদে, সেখানে পাশে দাঁড়িয়েছেন আরএসএস-র ‘সাক্ষাৎ দূর্গা!’
তাই শুধু মজলিশপুর, বক্সানগরই নয়। ত্রিপুরায় ২৮টি কেন্দ্রেই তৃণমূলের সেই লক্ষ্য — বিজেপি-বিরোধী ভোটে ভাঙন ধরানো। উদ্দেশ্য? বিপদে পড়েছে বিজেপি ত্রিপুরায়। সেই বিপদ থেকে বিরোধী ভোট ভেঙে বিজেপি-কে উদ্ধার করা।
তৃণমূলের যে ১০-১২জন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলা গেল, তাঁদের অন্যতম হারাধন দেবনাথ। বিশালগড় কেন্দ্রে ‘দিদির প্রার্থী।’ তাঁর কথায়,‘‘বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ হবে এটা ঠিক। কিন্তু ‘সিপিএম-কংগ্রেস’-র জোটটি মানুষ মেনে নিতে পারছে না।’’
‘জোটটা ঠিক হয়নি’ — এই প্রচারটিতে বিশেষ জোর দিয়েছে তৃণমূল। এই প্রচার চালিয়ে বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাঙার পাশাপাশি আর একটি উদ্দেশ্য পূরণে নেমেছে মমতা ব্যানার্জির দল। সেটি কী? মানুষকে বিভ্রান্ত করা, বামপন্থীদের দুর্বল করা। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দুর্বল করা। বিজেপি-র সেই দিক দিয়েও জাতীয় ক্ষেত্রে লাভ।
এই ছক তৈরি হয়েছে নাগপুরে — আরএসএস-র সদর দপ্তরে। একসঙ্গে দুই লক্ষ্য — বিজেপি-র জিত, দেশে বামপন্থী সহ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে আরও দুর্বল প্রতিপন্ন করা। এই প্রেক্ষাপটেই সোমবার এবং মঙ্গলবার মমতা ব্যানার্জি প্রচারে যাচ্ছেন ত্রিপুরায়। পুজো দেবেন বিশালগড়ের শিব মন্দিরে।
কিন্তু তৃণমূল কী সত্যিই বিজেপি-কে রুখতে চায়? কী অভিজ্ঞতা আবদুল বসিত খানের? এই মানুষটি ফিরে গেছেন কংগ্রেসে। গত ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনে ধর্মনগর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। রবিবার বললেন,‘‘আমার বাড়িতে তৃণমূলের ধর্মনগর জেলা অফিস করেছিলাম। অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু একবারের জন্যও এদিকে পা দেননি তৃণমূলের নেতারা। আমরা যখন আক্রমণের মুখে তখন কোথায় তৃণমূল? অনেকবার ফোন করেছি। বরাবর সিপিএম-র বিরোধী আমি। আমি তাই ফের কংগ্রেসে ফিরে গেছি। বিজেপি-কে যদি হটাতে হয় ত্রিপুরায় সিপিএম-কংগ্রেস জোট ঠিকই হয়েছে। তৃণমূল আদৌ বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়তে চায় না।’’
তৃণমূলের অবস্থা অবশ্য কহতব্য নয়। প্রমাণ? অনন্ত ব্যানার্জির অভিজ্ঞতা। টাউন বরদলুই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করেছে। এই কেন্দ্রের প্রার্থী ত্রিপুরার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা। অনন্ত ব্যানার্জি অসহায় সুরে জানালেন, ‘‘আমাকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে ৩০ তারিখ রাত দেড়টার সময়। কোনও মানে হয়? আপনি বলুন। আরও আগে হলে একটা কথা ছিল। তবু প্রার্থী যখন করেছে চেষ্টা করে দেখছি। বাড়ি বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছি।’’
আপনাদের তো সরকার গড়ার কোনও সুযোগ নেই। ৬০টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৮টিতে প্রার্থী দিয়েছেন। আপনাদের উদ্দেশ্য কী? প্রশ্নটি করেই ফেলা গেল অনন্ত ব্যানার্জি। তিনিও অকপট। বললেন,‘‘ঠিক। আমরা মাত্র ২৮তে প্রার্থী দিয়েছি। আসলে আমরা ডিসিসিভ ফ্যাক্টর হতে চাই এবারের ভোটে।’’
বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ভোট কেটে ‘ডিসিসিভ’ হতে নেমেছে তৃণমূল — এক অঙ্ক।
Comments :0