Tribeni Kumbha Mela

ত্রিবেণীর কুম্ভ মেলার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত

সম্পাদকীয় বিভাগ

গৌতম রায়
 

ধর্মপালন, ধর্মাচরণকে ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত করবার যে রাজনৈতিক খেলাটা হিন্দি বলয় জুড়ে বিগত প্রায় দুই দশক ধরে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির জোরদারভাবে করে চলেছে। এভাবেই তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি-কে কেন্দ্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। সেই বিভাজনের রাজনীতিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে আরও তীব্র করতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের নিত্য নতুন কৌশলের প্রয়োগ তারা বাংলায় করে চলেছে। সেই প্রয়োগেরই সর্বশেষ উদাহরণ ত্রিবেণীতে সঙ্ঘ পরিবার এবং রাষ্ট্রশক্তির সম্মিলিত আয়োজনে তথাকথিত ‘কুম্ভমেলা’।
কাল্পনিক ধর্মীয় ট্যাবুকে ইতিহাস বলে মানুষের কাছে তুলে ধরে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি বিশ শতকের শুরু থেকেই গোটা হিন্দি বলয় জুড়ে জোরদারভাবে শুরু করেছিল। এক্ষেত্রে ‘কুম্ভমেলা’-কে ধর্ম চর্চা থেকে ধর্মান্ধতার আঁতুড়ঘরে পরিণত করবার প্রবণতা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির গোটা বিশ শতক ধরেই দেখিয়ে এসেছে। সেই প্রবণতাই পরবর্তী সময়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের হিন্দুত্বের রাজনীতির বিকাশ এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রটিকে আরও অনেক দ্রুত প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।


  হিন্দি বলয়ের এই পদ্ধতিকে হিন্দুত্ববাদীরা বাংলার বুকে প্রয়োগের চেষ্টা করেনি তা নয়। স্বাধীনতা এবং দেশভাগের পরবর্তী সময়ে বিভাজনের রাজনীতিকে এই রাজ্যে শক্তিশালী করতে ব্রাহ্মণ্যবাদকেও জোরদার মদত জুগিয়েছে আরএসএস, তাদের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা, তার বিবর্তিত রূপ, ভারতীয় জনসঙ্ঘ এবং এখন প্রায় বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া রামরাজ্য পরিষদ। বাংলার বুকে বর্ণাশ্রমকে ফিরিয়ে আনার দাবি নিয়ে এই রামরাজ্য পরিষদ স্বাধীন ভারতে বেশ কয়েকটি ভোটেও লড়াই করেছিল।
  বামপন্থী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, বিশেষ করে দেশভাগের দরুন ছিন্নমূল মানুষদের রুটি- রুজি- বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দাবিতে বামপন্থীরা যে আন্দোলনের প্রবহমানতা তৈরি করেছিল, তার প্রত্যক্ষ ফল হিসাবেই এই সাম্প্রদায়িক শক্তির এই রাজ্যে বিভাজনের রাজনীতি, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির জাতপাতের বিভাজন— এসব কিছুকেই এই রাজ্যের বুকে দাগ কাটতে দেয়নি।
   বামপন্থীদের এই রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত করতে আরএসএস তাদের স্বাভাবিক মিত্র হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যখন কার্যত আটের দশকের গোড়া থেকেই বেছে নিয়েছিল, তখন থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল, মমতাকে দিয়ে কীভাবে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের সম্প্রীতির পরিবেশ তারা বিনষ্ট করবে। সেই লক্ষ্যে তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মুসলমানদের হয়ে আইনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি লড়াইয়ের যে নাটুকে পরিবেশ, বিশেষ করে টাডা আইনের অপপ্রয়োগ ঘিরে মুসলমানদের হয়ে আইনি লড়াইয়ের অভিনয়, সে সবগুলিই ছিল, মুসলমান সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে, রাজনৈতিক হিন্দুদের তো বটেই, সাধারণ হিন্দু সমাজের মানুষজন, যাঁরা খুব তলিয়ে রাজনীতিকে দেখতে অভ্যস্ত নন তাঁদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। আর পশ্চিমবঙ্গে ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের ভিতরে সাম্প্রদায়িক তাগিদ তাদের মধ্যে নতুন করে জাগিয়ে দিয়ে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র অভীষ্ট রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি করাই ছিল সিদ্ধার্থশঙ্করের উদ্দেশ্য। কারণ, আমরা দেখতে পেয়েছি, ’৯২-’৯৩ এর মুম্বাই বিস্ফোরণ, টাডা আইনে অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের গ্রেপ্তার— এই ঘটনাক্রমের সময়ে টাডা আইনের দোহাই দিয়ে মুসলমানদের উপর অত্যাচার ঘিরে সিদ্ধার্থশঙ্কর এবং মমতার তখনকার যে আস্ফালন, তা কিন্তু আদৌ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সিদ্ধার্থশঙ্কর ও টাডা ঘিরে তাঁর আইনি লড়াই আদালতের ভিতরে আর জারি রাখেননি এবং মমতাও ওই কালাকানুনে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমান সমাজের জন্যে আর একটিও কথা বলেননি।


 মজার কথা হলো, সিদ্ধার্থ- মমতার সেদিনের ভূমিকার ফলে ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশকে সহজেই সাম্প্রদায়িক প্ররোচনায় মাতিয়ে দেওয়া সম্ভবপর হলো আরএসএস- বিজেপি’র। আমাদের মনে রাখা দরকার, আজ গোটা দেশে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে সম্বল করে পর পর দুইবার কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করে আছে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির এবং তাদের শক্তি জোগাতে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন থেকে এই রাজ্যেও নানা ধরনের বিভাজনের রাজনীতির পরিবেশ রচনা করে যাচ্ছে, তার মূল পরিকল্পনা কিন্তু আরএসএস হঠাৎ করে একদিনে করেনি। একটা দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সামাজিক কার্যক্রমের আবরণ দিয়ে, অত্যন্ত পরিকল্পিত সামাজিক প্রযুক্তির ভিতর দিয়ে করেই আজ এমন একটা পরিবেশ গোটা হিন্দি বলয়ের ধাঁচেই প্রায় এই রাজ্যে আরএসএস সংক্রমিত করতে পেরেছে যার জেরে সামাজিক গণমাধ্যম থেকে সামাজিক জীবন, সর্বত্রই ধর্মচর্চাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক অভিসন্ধি নিয়ে তারা ধর্মান্ধতার পথে এগিয়ে, ধর্মের রাজনৈতিক প্রয়োগ অত্যন্ত সফলভাবে ঘটাতে শুরু করেছে।
   ধর্মের রাজনৈতিক প্রয়োগের অংশ হিসাবেই দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মন্ত্রী হিসাবে মমতা কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্যে নার্সিং কলেজ ইত্যাদির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিভিন্ন মৌলবিদের সামনে রেখে সেইসব প্রতিশ্রুতি ঘিরে সাধারণ, গরিব মুসলমানদের নানা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তার আসল উদ্দেশ্য ছিল; পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের ভিতরেও অর্থনৈতিক আঙ্গিককে উসকে দিয়ে একটা সাম্প্রদায়িক ঈর্ষার পরিবেশ তৈরি করা।


    সেই সাম্প্রদায়িক ঈর্ষার পরিবেশ তৈরি করে ‘স্বাভাবিক মিত্র’ বিজেপি’র ভোট বাক্সে সুফল তুলে দেওয়ার পরেও মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার খেলা জোরকদমে চলছে। মমতার সেই কৌশলকেই সফলভাবে আরএসএস কাজে লাগিয়েছে সম্প্রতি হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে ওই তথাকথিত কুম্ভ মেলায়। বিভিন্ন নামী দামি বাংলা দৈনিকে লেখা হয়েছে, সাতশো, আবার কোথাও আটশো বছর পরে ত্রিবেণীতে গ্রহ নক্ষত্রের ‘বিশেষ যোগে’ এই মেলা হচ্ছে। তৃণমূল পরিচালিত স্থানীয়  পৌরসভার চেয়ারম্যানও সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, তাঁর এলাকার গবেষকরা নাকি এই আটশো বছরের পুরানো ত্রিবেণীর কুম্ভ মেলার কথা বিস্তারিত গবেষণা করে উদ্ধার করেছেন। বলা বাহুল্য, কারা সেই গবেষক, কোথায় প্রকাশিত হয়েছে সেই আজগুবি গবেষণাপত্র, আন্তর্জাতিক মহলের কোন স্তর থেকে মিলেছে সেই গবেষণার স্বীকৃতি- এসব সম্পর্কে সেই তৃণমূলী পৌর চেয়ারম্যান একটাও শব্দ উচ্চারণ করেননি। যে খবরের কাগজ বা পোর্টালগুলি এই তথাকথিত গবেষণার খবর সাড়ম্বরে প্রকাশ করেছে, তারাও কেউ তথাকথিত গবেষণার সত্যাসত্য সম্পর্কে একটাও প্রশ্ন তোলেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের এই গবেষণার লেবাস যুক্ত রাজনৈতিক অভিসন্ধির পিছনে যে আর আরএসএস- বিজেপি’র পরিপূর্ণ মদত আছে তা ওই তথাকথিত ‘কুম্ভমেলা’ ঘিরে গোটা সঙ্ঘ পরিবারের অতি সক্রিয়তা এবং খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের ওই তথাকথিত মেলাকে সফল করবার উদ্দেশ্যে জারি করা বিজ্ঞপ্তির ভিতর দিয়ে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।
  ত্রিবেণীর ওই তথাকথিত ‘কুম্ভমেলা’-কে ঘিরে গোটা সঙ্ঘ পরিবার ঝাঁপিয়ে পড়লেও ত্রিবেণীকে ঘিরে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চায় এই কুম্ভমেলার অস্তিত্ব কখনোই দেখা যায়নি। ত্রিবেণীর খুব কাছেই রয়েছে ‘জাফর খাঁ গাজী’র দরগা। বাংলার দ্বিতীয় মাদ্রাসাটি এখানেই স্থাপিত হয়েছিল। প্রথমটি হয়েছিল ঢাকার অদূরে সোনারগাঁতে। ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজীর দরগাটি ‘দেবতা বিশ্বকর্মা’র সৃষ্টি এবং মুসলমানরা সেটি ধ্বংস করেছে, গত তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে আরএসএস নানা পর্যায়ে এটা প্রচার করে। ওই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের ভিতরে এই কাল্পনিক প্রচারকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, কোনও পর্যটক ওই প্রাচীন দরগা দেখতে গেলে স্থানীয় ছোট ছোট ছেলেরাও গাইডের ভূমিকা পালন করার নাম করে একটা পাথরের খণ্ড দেখিয়ে, সেটিই বিশ্বকর্মার কুঠার, এই বলে পর্যটকদের উপর একটা প্ররোচনা মূলক ভাবাবেগ তৈরি করে। সমরেশ বসু কালকূট ছদ্মনামে এই জাফর খাঁ গাজীর দরগা এবং ত্রিবেণীকে ঘিরে ‘মুক্তবেণীর উজানে’ নামক একটি কালজয়ী সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার করা বিশ্বকর্মার কুঠার বা ত্রিবেণীতে চোদ্দ শতকে কুম্ভমেলা এসব আজগুবি কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক কথা সমরেশ বসু একবারও ব্যবহার করেননি ওই উপন্যাসে। কালকূটের ওই উপন্যাসটি সাতের দশকে লেখা ও প্রকাশিত। বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্বকর্মার কুঠার ঘিরে গালগল্পের অবতারণার শুরু সাতের দশকের পরবর্তী সময়ে।


  ত্রিবেণীতে এই তথাকথিত কুম্ভমেলা, তা ঘিরে গোটা সঙ্ঘ পরিবারের ভিতরে শোরগোল, কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা, তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা, মমতার সরকারের ভূমিকা— এইসবের পিছনে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে জাফর খাঁ গাজীর দরগা সহ নানা আঞ্চলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গঙ্গার দুই পাড় ঘিরে হিন্দু- মুসলমানের সহাবস্থানকে বিঘ্নিত করার একটা ঘৃণ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই আরএসএস, তার প্রত্যক্ষ সঙ্গী এবং পর্দার আড়ালের সঙ্গী তৃণমূল কংগ্রেসকে ব্যবহার করে, আগামী লোকসভা ভোটের লক্ষ্যে অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতেই এগচ্ছে।
   হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরকে সুযোগ করে দিতে এই গোটা অঞ্চল জুড়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা চলছে। ভাটপাড়ার গঙ্গার ঘাটে ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজের ভিতর দিয়ে গঙ্গা আরতি হয়েছে। স্থানীয় একটি কালী মন্দিরের একটানা প্রায় পঞ্চাশ বছরের সভাপতি তথা বারাসত কোর্টে তৃণমূল সরকার নিয়োজিত সরকারি প্লিডার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আয়োজিত এই রাজনৈতিক আরতিতে অংশ নিয়েছেন। হালিসহরে সাধক রামপ্রসাদের স্মৃতি বিজড়িত গঙ্গার ঘাটে সেখানকার তৃণমূল বিধায়ক এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনামী শাখার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আরতিতে ‘গোহত্যা’ ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের স্লোগান সাড়ম্বরে দেওয়া হয়েছে। নৈহাটিতে ‘বড় কালী’-র নাম করে ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানীয় একটি ধর্মশালা কার্যত দখল করে মন্দির তৈরির সঙ্গে চলছে ধর্ম আর রাজনীতির এক ভয়ঙ্কর খেলা শাসকের প্রত্যক্ষ মদতে।
  লোকসভার ভোট যত এগিয়ে আসবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে ততই বিজেপি বিরোধিতার নাটক করে নিজের দলের কর্মী, সমর্থকদের সঙ্গে আরএসএসের গোপন গভীর সংযোগ ঘটিয়ে ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটিয়ে মেরুকরণের রাজনীতিকে তীব্র করে তুলবেন। মন্দির- মসজিদের রাজনীতি হিন্দি বলয়ের মতো এই রাজ্যে মমতা যত প্রকট করে তুলতে পারবেন ততই রাজনৈতিক লাভ আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র।

Comments :0

Login to leave a comment