এবারও সেই সন্ত্রাসবাদীদের ফাঁদে পা দিল কেন্দ্র। মঙ্গলবার হঠাৎই পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল কাশ্মীরের ৪৮টি জায়গা। পর্যটকদের জন্য বন্ধ হয়ে গেল শ্রীনগরের জামিয়া মসজিদের দরজা। কাশ্মীরের পর্যটনই যে পহেলগামের হামলা, তা অমিত শাহ থেকে কাশ্মীর আম জনতা সকলেই বলছেন। আর এখন কেন্দ্রের সরকারই সন্ত্রাস তৈরি করতে নেমে পড়লো। সাতদিন আগে বৈসরনের বুগিয়ালে একজনও নিরাপত্তা জওয়ান না থাকলেও এখন ৪০-৫০ জওয়ান বেষ্টিত অমিত শাহ সেই পর্যটনের কোমর ভাঙার নিদান দিলেন। স্থানীয় দোকানদার থেকে ঘোড়াওয়ালা সকলেই মানছেন, এ তো সেদিনের চেয়েও বড় আঘাত। পর্যটক আসা আরও কমে যাবে।
ঘটনার দু’দিন পর সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে কেন্দ্র সাফাই দিয়েছিল, অনুমতি না নিয়ে ট্যুর অপারেটাররা খুলে দিয়েছিল বৈসরণ। তবু বলেনি স্পর্শকাতর ওইরকম একটা স্পটে কেন কোনও নিরাপত্তা জওয়ান ছিল না। তবে সময় পেরতে সব মিথ্যাই সামনে এসে গিয়েছে। আর শুরু হয়ে গিয়েছে যুদ্ধ জিগির তোলা। জল বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা হাতে না থাকা সরকার সিন্ধু জল চুক্তি বন্ধের আস্ফালন ছুঁড়ছে। আর ‘স্বাভাবিক কাশ্মীরে’ পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পর্যটকদেরই নিষিদ্ধ করে দিল কাশ্মীরে।
গুরেজ, বাঙ্গাস, মাচিল, ভেরিগান, ইউসমার্গ সহ এই তালিকায় থাকা উপত্যকার এরকম বহু জায়গায় পর্যটক, ট্রেকাররা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে যান। কিছু দিন কাটান সেখানে। বিশেষ করে বছরের এই সময় বরফ ধীরে ধীরে গলে রাস্তা পরিষ্কার হতে থাকায় পাহাড়ের উপরে বহু গ্রামই ‘ডেস্টিনেশন’ হয়ে ওঠে। বান্দিপোরা, বাদগাম, কুলগাম, সোপোর, অনন্তনাগ, কুপওয়ারা, হান্দওয়ারা, পুলওয়ামা, গান্ডেরবাল, শ্রীনগরের তথাকথিত ‘অফবিট’ জায়গাগুলিতেও বেশ কিছু বছর ধরে ট্রেকার এবং পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে হোমস্টে-র মালিক থেকে চা দোকানি, স্থানীয় প্রত্যেকেই ঘরে মজুত করেন খাবারদাবার সহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। সামান্য লাভের আশায় বিরাট পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু বৈসরণ ভ্যালিতে ভয়ঙ্কর ওই সন্ত্রাসবাদী হামলায় এক জন কাশ্মীরি সহ ২৬ জনের মৃত্যুর পর আপামর কাশ্মীরবাসীকে ‘সন্ত্রাসবাদী’র তকমা দিয়ে উপত্যকাকে বয়কট করার ডাক দেন নেটিজেনদের এক অংশ। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নরেন্দ্র মোদীর সরকার কোনও দায় নেয়নি। উলটে গোদী মিডিয়া এবং নিজেদের আইটি সেলকে কাজে লাগিয়ে উগ্র জাতীয়বাদী প্রচার চালিয়ে এখন কাশ্মীরিদের কাঁধে বন্দুক রেখে তাঁরা যে নিরপরাধ তা প্রমাণের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। পর্যটন ব্যবসা যেখানে কাশ্মীরের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেখানে কাশ্মীরিদের এভাবে ভাতে মেরে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই’র খবর অনুযায়ী, কাশ্মীরের ৮৭টি পাবলিক পার্কের মধ্যে ৪৮টি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত বলে সূত্র মারফত দাবি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সরকারের তরফে কোনও নির্দেশিকা জারি করা হয়নি। ওই পর্যটন স্থানগুলি বন্ধ রেখে মূল দরজায় বা রাস্তার উপরেই নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েকবছরে পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের হয়ে ওঠে দুধপাথরি, কোকেরনাগ, দাকসুম, সিন্থন টপ, আহরবাল, মার্গান টপ, তোসাময়দান, বাদামওয়াড়ি। এই জায়গাগুলিও রয়েছে এই তালিকায়। দক্ষিণ কাশ্মীরের একাধিক মুঘল গার্ডেনও এভাবেই আচমকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটকরা আর এখানে ঢুকতে পারবেন না। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’-কে একজন সরকারি আধিকারিক বলেছেন, ‘পহেলগামের মতো প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সন্ত্রাসবাদীদের উপস্থিতির খবর রয়েছে। তাই আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে জায়গাগুলিতে মূলত কিছুটা পথ ট্রেক করে পৌঁছাতে হয়, সেখানেই আপাতত এমন ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশ-বিদেশের পর্যটকরা নিশ্চিন্তে কাশ্মীরে আসছিলেন, বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন— এই পরিস্থিতিকেই বদলে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করতেই সন্ত্রাসবাদীরা ওই নৃশংস হামলা চালায়। সন্ত্রাসবাদীদের অ্যাজেন্ডায় শিলমোহর দিয়ে কেন্দ্র এখন কাশ্মীরিদের রোজগারটুকু কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করছে।
Comments :0