আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও নিয়মবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ‘যুদ্ধপরাধ’-এর সীমা ছাড়াচ্ছে ইজরায়েল। গাজার বুকে ইজরায়েলের গণহত্যার অভিযানের পাশাপাশি সেখানে এখন দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে তাদের অবরোধের কারণে। গাজাকে জনশূন্য করে দিয়ে সেখানে স্থায়ী দখল কায়েম করতে গণহত্যার অভিযান চালাচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। পরের পর হামলা চালিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের জোর করে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে তারা এগচ্ছে মার্কিন মদতে। নতুন অভিযান শুরুর পর গাজায় ইতিমধ্যে প্রায় একশোজন নিহত হয়েছেন। তার পাশাপাশি অবরোধ সৃষ্টি করে খাদ্য ও জরুরি পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে মানুষকে বিশেষত শিশুদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, কারণ দুর্ভিক্ষের মৃত্যুর ঘটনা ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফেও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, হাতে মারার পাশাপাশি ভাতের মারার এই চক্রান্তে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হতে চলেছে শিশুদের।
গাজার পাশাপাশি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জেনিনেও ইজরায়েলী সেনারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, জেনিনে যাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে তাঁদের মধ্যে ইতালির এক কূটনৈতিক দলও উপস্থিত ছিল। গোলাগুলির মধ্যে এই দলের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন। ইজরায়েলী গুলিবৃষ্টি থেকে পালিয়ে তাঁদের সবাইকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতালির সরকার এতে ক্ষিপ্ত হয়েছে,ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে ইতালির বিদেশ মন্ত্রী ডেকে পাঠিয়ে সতর্ক করেছে এবং জানিয়েছে, তদন্তে যদি প্রমাণ হয় ইজরায়েলী সেনা হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে গুলি চালিয়েছে তবে তাদের গুরুতর ফল ভোগ করতে হবে। বাস্তবে এভাবেই প্রতিদিন আক্রমণের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে গাজার বাসিন্দাদের। ইজরায়েলী সেনার গুলি বোমায় যে কোনও সময়ে প্রাণ যেতে পারে যে কোনও মানুষের। মার্কিন মদতে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার মিথ্যা যুক্তি দেখিয়ে এই গণহত্যাকারী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। কিন্তু ধারাবাহিক এই আক্রমণেই তারা থেমে থাকেনি, গাজাকে চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশও বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। গত আড়াই মাস ধরে খাবার, পানীয় জল, জরুরি ওষুধপত্র সহ নানা ত্রাণ সামগ্রীর উপর অবরোধ চাপিয়ে রেখে শহরে কৃত্রিমভাবে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে সেখানে ত্রাণ পাঠিয়েছে, কিন্তু ইজরায়েল সেই ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশে এবং বণ্টনে অসহযোগিতা করে চলেছে। ইজরায়েলের পক্ষ থেকে কয়েকটি ট্রাক ঢোকার কথা বলা হলেও রাষ্ট্রসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, ‘ঐ ত্রাণ প্রয়োজনের সমুদ্রের তুলনায় কয়েকটি ফোঁটা মাত্র। প্রতিদিন ছয়শো ট্রাক ত্রাণ দরকার সেখানে।’ তাঁর এই আশঙ্কামূলক পর্যবেক্ষণেই গাজার দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির গভীরতা অনুমেয়।
তবে সশস্ত্র হামলার পাশাপাশি এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী অবরোধের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র ধিক্কার শোনা যাচ্ছে ইজরায়েলের প্রতি। অবিলম্বে যাবতীয় ত্রাণ সামগ্রী গাজায় ঢোকার অনুমতি দিয়ে, সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য ইজরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে অনেক পশ্চিমী দেশও। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইজরায়েল আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। চলতি সপ্তাহে এই প্রথমবার ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের’ হুমকি দিয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও কানাডার মতো দেশগুলিও। আন্তর্জাতিক মহলের এই তীব্র চাপেই ত্রাণে অবরোধ আংশিকভাবে তুলতে বাধ্য হচ্ছে ইজরায়েল। যে জার্মানি ইজরায়েলের পাশে ছিল, তারাও অবরুদ্ধ গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। গাজায় ত্রাণ সামগ্রীর ওপর অবরোধ তুলে না নিলে ইজরায়েলকে যাবতীয় অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাণিজ্য চুক্তিও স্থগিত রাখার কথা বলা হয়েছে। ত্রাণ ও শহর পুনর্নির্মাণের জন্য প্রায় ৫০ লক্ষ ডলার অর্থ সাহায্যের ঘোষণা করেছে ব্রিটেন। সামগ্রিকভাবে ইজরায়েলের প্রতি ইউরোপের এই মনোভাব আসলে ইজরায়েলী বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমতের প্রকাশ বলেই মনে করা হচ্ছে।
Editorial
দুর্ভিক্ষের ছায়া গাজায়

×
Comments :0