ADANI AND CO.

বাটপারিয়ারা আজও বহাল তবিয়তে

জাতীয়

ADANI AND CO

শমীক লাহিড়ী

রাজশেখর বসুর এক অনবদ্য গল্প শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড। যাঁরা পড়েছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই কুখ্যাত চরিত্র গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াকে। গন্ডেরিরাম শুধু প্রতারকই নয়, অন্যদের তুলনায় সে অনেক বেশি ঝুঁকিও নিতে পারে। একে  বর্ণনা করা হয়েছিল এইভাবেই - দুঃসাহসিক ব্যবসায়ী গন্ডেরিরাম আসরে অবতীর্ণ হওয়া মাত্র নিমেষ মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা জমকালো হইয়া উঠিল, আকাশে যেন তড়িৎ প্রবাহ খেলিয়া গেল এবং দুই-চার হাজার হইতে আমরা এক লাফে দুই-চার লাখের জগতে উন্নীত হইলাম।

ধর্ম ব্যবসায়ীদের এমন লোভী চকচকে চোখ আর উল্লাসের বর্ণনা আর কোন গল্পে করা আছে জানি না। আজ এই গল্প লিখলে নিঘঘাত মোদীবা আদিওনাকে UAPA ধারায় যাবজ্জীবন ফাঁসীই দিত। বাটপারিয়ারা এখনও বহাল তবিয়তেই আছে, শুধু পদবিগুলো আলাদা।

৩ বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে এযুগের গন্ডেরিরাম, গৌতম আদানির। ঠিক যেভাবে শুধু শেয়ারের ভেলকিবাজিতে বাটপারিয়া বিপুল অর্থ কামিয়ে সরে পড়েছিল, তেমনই কাজে সিদ্ধহস্ত আদানি ভাইয়েরা। আর আদানী ভাইদের রকেট গতিতে উত্থান মোদী ভাইয়ের দাক্ষিণ্যেই। এই দুই ভাই’ (নাকি ভাইরাস) এখন দেশের সম্পদের বিক্রেতা ও ক্রেতা।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ টীমের ১০০রও বেশি পাতার রিপোর্ট, তার উত্তরে আদানি ভাইদের ৪ শতাধিক পাতার ধোকলা উত্তর, আবার তার উত্তরে হিন্ডেনবার্গের প্রেস বিবৃতি, যাতে বলা হয়েছে আদানি ভাইদের বিরুদ্ধে ওঠা ৮৮টি প্রশ্নের ৬৬টিরই উত্তর দিতে পারেননি। 

এইসব পড়ে যে কারোরই মাথাটা ঘুরে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই ভালো করে বোঝার জন্য পরশুরামের অমর সৃষ্টি এই গল্পটা আর একবার পড়া খুবই জরুরি। ঠিক ১০১ বছর আগে কিভাবে হর্ষদ মেহেতা, আদানি ভাইদের চিনেছিলেন রাজশেখর বসুর মতো এক রসায়নবিদ, এটা বোঝা খুবই দুষ্কর।

ধর্ম ব্যবসায়ীদের আর শেয়ার বাজারের প্রতারকদের উন্মোচিত করার কাজ এত সুচারু ভাবে ভূভারতে আর কেউ করতে পেরেছেন কি না জানা নেই।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ কোম্পানি কারা?

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আমেরিকা নিউইয়র্কের একটি সংস্থা। নাথান এন্ডারসন ২০১৭ সালে এই কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানিটি মূলত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত গবেষণার কাজ করে। ১৯৩৭ সালের ৬ই মে আমেরিকার নিউজার্সির কাছে একটি জার্মান উড়ো জাহাজ ভেঙে পড়ে। সেই সময় অভিযোগ উঠেছিল এই দুর্ঘটনা আসলে একটি অর্ন্তঘাত। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কোম্পানির নামকরণ করা হয়েছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।

এই কোম্পানি দাবি করে যে, তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই মূলত কাজ করে। কর্পোরেট কোম্পানি এবং শেয়ার বাজারের মধ্যে যে সব সন্দেহজনক প্রতারণার ঘটনা ঘটে, তাদের উপর নজরদারি চালায় এই কোম্পানি।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই সংস্থা আমেরিকার নিকোলা কর্পোরেশন নামে একটি কোম্পানির শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করে প্রতারণার ঘটনা প্রকাশ করে। প্রথমে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠতা ট্রেভর মিলটান অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরবর্তী তদন্তে প্রমাণিত হয়, এই প্রতারণার ঘটনা সত্য।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চিকিৎসা সংক্রান্ত কর্মসূচী 'ক্লোভার হেল্থ' নিয়ে আর একটি শেয়ার বাজারে প্রতারণার ঘটনা প্রকাশ করে এরা। শেয়ার বাজারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধনী দালাল চামাথ প্যালিহ্যাপিশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বিনিয়োগকারীদের ভুল পথে পরিচালিত করেছেন, এই অভিযোগ আনে হিন্ডেনবার্গ। 'ক্লোভার হেল্থ' এর পরিচালকমন্ডলী এই  অভিযোগ প্রথমে অস্বীকার করলেও, একথা স্বীকার করেছে তারা সে দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত নোটিশ পেয়েছেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ 'অন লাইন বেটিং অপারেটার ড্রাফটকিংস', ভূ-তাপীয় শক্তি উৎপাদন কোম্পানী (Geothermal Power) অরম্যাট টেকনোলজিস, বৈদ্যুতিক গাড়ী তৈরীর কোম্পানি মূলেন টেকনোলজিস সহ বিভিন্ন কোম্পানি শেয়ার বাজারকে অন্যায়ভাবে প্রতারিত করার চেষ্টা করেছে - এই সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এলেন মাস্ক যখন ট্যুইটার কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছিলেন, তখন বেআইনি ভাবে শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন - এই সংক্রান্ত রিপোর্টও এরা প্রকাশ করেছে।

আদানি সংক্রান্ত রিপোর্ট 

২৪শে জানুয়ারি, ২০২৩ হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট তৈরি করার জন্য তারা ২বছর ধরে অনুসন্ধান চালায়। ১০০ পাতারও বেশি এই অনুসন্ধান রিপোর্টে তারা কতগুলি গুরুতর সাংঘাতিক প্রতারণার অভিযোগ তোলে আদানি গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর বিরুদ্ধে। মূল অভিযোগগুলি নিম্নরুপ - 

১. ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা) সম্পদের মালিক গৌতম আদানি সাংঘাতিকভাবে শেয়ার বাজারে দুর্নীতি করেছেন। প্রতারণা, অন্যায় ও বেআইনি কৌশল গ্রহণ  সহ নানাবিধ অপরাধের মাধ্যমে বিগত ১ দশক ধরে এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।

২. এই ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে বিগত মাত্র ৩ বছরে। আর এই সম্পদ বৃদ্ধি মূলত ঘটেছে আদানির বিভিন্ন কোম্পানিগুলির অস্বাভাবিক হারে শেয়ারদর বা মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে। এদের ৭টি স্টক এক্সচেঞ্জ ভুক্ত মূল কোম্পানির শেয়ারগুলির বাৎসরিক বৃদ্ধির গড় ছিল ৮১৯%। 

৩. আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিগুলির শীর্ষে বসে থাকা প্রায় সবাই গৌতম আদানির পরিবারেরই সদস্য। অর্থাৎ এক কথায় এটি মূলত পারিবারিক ব্যবসা।

৪. এর আগে ৪টি সরকারি তদন্তে এদের জালিয়াতির কথা প্রকাশ্যে এসেছিল। মোট জালিয়াতির পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা)।

৫. বিভিন্ন ছদ্ম ও বেনামী কোম্পানি (Shell Company) তৈরী করে মরিশাস, সংযুক্ত আমিরশাহী ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের নানা দেশের মাধ্যমে বেআইনী লেনদেন এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিজেদের শেয়ার মূল্যকে দেখানোর কাজ করেছে আদানি গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ।

৬. গৌতম আদানির ভাই রাজেশ আদানি ২০০৪-২০০৫ সালে হীরা ব্যাবসার ক্ষেত্রে এই ধরণের ছদ্ম ও বেনামী কোম্পানীর মাধ্যমে লেনদেন করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। Directorate of Revenue Intelligence তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং রাজেশ আদানি ২বার গ্রেফতারও হন, কর ফাঁকি ও প্রতারণার অভিযোগে। একইভাবে গৌতম আদানির শ্যালক সমীর ভোরাও Directorate of Revenue Intelligence দ্বারা অভিযুক্ত হন ঐ একই মামলায়।

৭. গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি একটি অত্যন্ত রহস্যময় চরিত্র। এর মূল কাজ বিদেশে বিভিন্ন ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির মাধ্যমে আদানি গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের মূল কোম্পানিগুলিতে বেআইনী টাকার লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার মূল্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে দেখানো। শুধুমাত্র মরিশাসেই বিনোদ আদানি এবং এর ঘনিষ্ঠদের এরকম ৩৮টি ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির হদিশ পাওয়া গেছে। এছাড়াও সাইপ্রাস, সংযুক্ত আমিরশাহী, সিঙ্গাপুর ও বিভিন্ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এই রকম আরও অনেক ছদ্ম-বেনামী কোম্পানি চালায় বিনোদ আদানি এবং তার ঘনিষ্ঠরা। এই ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির কর্মচারী, ঠিকানা ইত্যাদি অদ্ভুতভাবে হয় একই, নয় অনুল্লেখিত। উদাহারণ স্বরুপ এই কোম্পানিগুলির ১৩টা ওয়েবসাইট সন্দেহজনকভাবে একই দিনে তৈরি করা হয়েছে এবং কোম্পানিগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্য অত্যন্ত ভাসাভাসা অথবা অনুপস্থিত।

৮. হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তথ্য সংক্রান্ত আইনে সেবির কাছ থেকে জানতে পারে যে এই বিদেশী কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সম্পর্কে তদন্ত শুরু হয়েছে। যদিও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম এই নিয়ে বিগত দেড় বছর ধরে নানা প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও সেবি নিজে থেকে কোনও তদন্ত শুরু করেনি।

৯. 'এলারা' নামক একটি শেয়ার বাজারে বিলিয়োগকারী কোম্পানি প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে আদানি'র নানা কোম্পানিতে। এদের কার্যকলাপ অত্যন্ত সন্দেহজনক।

১০. বর্তমানে জেলবন্দী শেয়ার বাজারের কুখ্যাত  জালিয়াত ও প্রতারক কেতন পারেখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ছদ্ম-বেনামী কোম্পানিগুলির গোপন ই-মেল পত্রালাপ ফাঁস হয়ে গিয়েছে। ধর্মেশ দোশী নামে এক রহস্যময় ব্যক্তির সাথে 'এলারা' বিনিয়োগ কোম্পানির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা এই ই-মেলগুলি থেকে প্রমাণিত হয়। ধর্মেশ দোশী বর্তমানে গ্রেপ্তারী এড়িয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। 

১১. 'মন্টেরোসা' নামক আর একটি বিনিয়োগকারী সংস্থা, আদানি গ্রুপের শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত কোম্পানিগুলির ৩৬ হাজার কোটি টাকার শেয়ার নিজেদের দখলে রেখেছে। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও এমন ৩টি কোম্পানির ডাইরেক্টর, যেগুলির মালিক বর্তমানে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত একজন হীরা ব্যবসায়ী, যিনি বর্তমানে ৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানির মেয়ের সাথে আবার এই পলাতক জালিয়াত হীরা ব্যবসায়ীর ছেলের বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

১২. 'নিউ লিয়াইনা' নামক একটি সাইপ্রাসস্থিত ছদ্ম-বেনামী কোম্পানি 'আদানি গ্রীন এনার্জি কোম্পানি'তে ৪২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে ২০২১ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। 'নিউ লিয়াইনা' মূলত আদানির শেয়ার মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর জন্যই তৈরি করা এবং এটা পরিচালনা করে 'এমিকর্প' নামে একটি পরিষেবা দেওয়ার কোম্পানি। 'এমিকর্প' অন্তত ৭টি আদানি গ্রুপের কোম্পানি এবং ১৭টি বিদেশী ছদ্ম-বেনামী কোম্পানির স্রষ্টা, যেগুলির সাথে মূলত বিনোদ আদানি যুক্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য 'এমিকর্প' আর্ন্তজাতিক প্রতারণায় অভিযুক্ত এবং মালেশিয়ার কর দাতাদের ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।

১৩. ২০০৭ সালে 'সেবি' তাদের তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল - আদানি গ্রুপের প্রোমোটাররা কুখ্যাত জালিয়াত কেতন পারেখকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে, এটা প্রমাণিত। এই রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ১৪টি আদানি নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, কেতন পারেখ নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিতে শেয়ার লেনদেনের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিল।   

১৪. আদানির বিভিন্ন সংস্থা নানা রকম গোপন বেআইনি লেনদেন চালিয়েছে নানা ছদ্ম-বেনামী কোম্পানীগুলির সাথে। যেমন বিনোদ আদানি নিয়ন্ত্রিত মরিশাসস্থিত একটি কোম্পানির সাথে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকার লেনদেন করেছে, কিন্তু তার কোনও উল্লেখ কোথাও নেই। এছাড়াও আরও ৯৮৪ কোটি টাকার একটি লেনদেনেরও কোনও উল্লেখ নেই। একইভাবে বিনোদ নিয়ন্ত্রিত সংযুক্ত আমিরশাহীস্থিত একটি সংস্থার মাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎ কোম্পানিতে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগেরও কোনও উল্লেখ নেই।

১৫. আদানির বিভিন্ন সংস্থার অডিট করে 'শাহ ধান্ধারিয়া' নামক একটি অডিট কোম্পানি। এই কোম্পানির বর্তমানে কোনও ওয়েবসাইট নেই। পুরানো ওয়েবসাইট আর্কাইভ থেকে দেখা যাচ্ছে এই কোম্পানির মাত্র ৪জন অংশীদার ও ১১জন কর্মচারী ছিল। মাত্র ৩২ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে এর অফিস ছিল। অথচ এদের শেয়ার মূল্য নাকি ৬৪কোটি টাকা। মাত্র ১১জন কর্মচারী নিয়ে ১৫৬টা আদানি নিয়ন্ত্রিত সংস্থার অডিট কি করে করা সম্ভব? আদানি টোটাল গ্যাস কোম্পানির বাৎসরিক অডিট রিপোর্টে যে অডিটরের স্বাক্ষর আছে, তাঁর বয়স মাত্র ২৩-২৪ বছর।

১৬. আমাদের তদন্ত প্রমাণ করে যে আদানি  গ্রুপ একটি বিশাল জালিয়াতি এবং প্রতারণা চালাতে পেরেছে বছরের পর বছর ধরে মূলত বিনিয়োগকারী, সাংবাদিক, নাগরিক এমনকি রাজনীতিবীদরও অনেকেই এদের দাপটে ভীত বলেই।

এছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠে এসেছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তদন্তে, যার সবটা উল্লেখ করা সম্ভব নয় একটি প্রবন্ধে। 

 

রকেট উত্থান, পেছনে কে

২০১৪ সালে আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিজের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আদানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৭ গুণ। ২০২১ সালেও মুকেশ আম্বানী গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ, আদানির চাইতে ২লক্ষ কোটি টাকা বেশি ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৬১২ কোটি টাকার সম্পদ বৃদ্ধি করে আম্বানীর চাইতে ৩ লক্ষ কোটি টাকা বেশি সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন গৌতম আদানি। 

 

কিভাবে এই রকেট গতিতে উত্থান সম্ভব হলো

২০০২ সালে গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে অভিযুক্ত তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশ থেকে সরে যায় বহু দেশি-বিদেশী শিল্প গোষ্ঠী। এই সময়েই আদানির মঞ্চে প্রবেশ। নরেন্দ্র মোদীর বৃত্তে অনুপ্রবেশ করে সরকারি দাক্ষিণ্যে অনেকগুলি সরকারী প্রকল্প এবং জমি হস্তগত করেন গৌতম আদানি। সখ্যতা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে সময়ের সাথে সাথে। 

 

২০১২ সালে 'ভাইব্র্যান্ট গুজরাট' শীর্ষক শিল্প সম্মেলনে প্রথম নরেন্দ্র মোদীকে জাতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন গৌতম আদানি সহ আরও কয়েকজন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করলে নরেন্দ্র মোদী হন দেশের প্রধানমন্ত্রী। গুজরাটের বৃত্ত ছাড়িয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে একই সাথে প্রবেশ ঘটে গৌতম আদানিরও। 

 

অতি দক্ষিণ পন্থার উত্থান এবং বাছাই করা কর্পোরেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি পরস্পরের হাত ধরেই চলে, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। 

কর্পোরেট পুঁজি বা লগ্নী পুঁজির বিশেষ সমর্থন ছাড়া অতি দক্ষিণ পন্থা বা ফ্যাসিবাদের উত্থান কখনই হয়না। প্রখ্যাত পোলিশ অর্থনীতিবীদ মিশ্যঁল কালেকি, ফরাসি অর্থনীতিবীদ ড্যানিয়েল গুয়েরিন সহ বহু অর্থনীতিবীদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইতালি, স্পেন, জার্মানী, জাপান ইত্যাদি দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পেছনে সেই সব দেশের বাছাই করা কর্পোরেটদের বিপুল বিনিয়োগ কিভাবে হয়েছিল, তথ্য সহকারে তুলে ধরেছেন নানান লেখায়। 

জার্মানির হিটলারের উত্থানের পেছনে বেয়ার কোম্পানি সহ আরও কয়েকটি কর্পোরেট, ইতালিতে মুসোলিনীর উত্থানে ফিয়াট সহ কয়েকটি কর্পোরেট, জাপানে তোজোর উত্থানে নিও জাইবাৎসু বা নতুন শিল্প গোষ্ঠী যেমন নিশান ইত্যাদি কর্পোরেটগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

একইভাবে আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে আদানি সহ হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেট বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে, যা আজ প্রমাণিত। দিল্লীর একটি অসরকারী সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিল। অর্থাৎ প্রতিটি লোকসভা আসনে গড়ে ৪৯.৮২ কোটি টাকা খরচ করেছিল বিজেপি। কোন কর্পোরেট কত টাকা দিচ্ছে কোন রাজনৈতিক দলকে, এটা যাতে প্রকাশিত না হয় তাই মোদী-শাহ জুটি ক্ষমতায় এসেই নির্বাচনী বন্ড প্রথা চালু করে। এই নতুন প্রথা অনুযায়ী কারা কোন রাজনৈতিক দলকে কত অর্থ দিচ্ছে তা প্রকাশ করা আর বাধ্যতামূলক নয়।

যে অর্থ ঢেলেছে এই কর্পোরেট কোম্পানিগুলি বিজেপির জন্য, তার কয়েকগুণ অর্থ লুঠ করে নিচ্ছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা। আজকের যুগে ক্রোনি  বা ধান্দার পুঁজিবাদ ও শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে এক আঁতাত গড়ে উঠেছে। এই অশুভ আঁতাতে ফলেই বিপুল লুট চালানো সম্ভব হচ্ছে বাছাই করা কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানির পক্ষে। 

 

বাতাসেও মুনাফা

যেমন কোভিডের সময় ২০২০-২০২১ সালে সমগ্র পৃথিবীর উৎপাদন ব্যবসা পরিষেবা লেনদেন প্রায় যখন স্তব্ধ ছিল, দেশের সাধারণ মানুষের কোনও আয় ছিল না, সেই সময়েই বিপুল সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছে আদানি-আম্বানী সহ কয়েকটি শিল্প গোষ্ঠী। ২০২১ সালে আম্বানির দৈনিক গড় সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে ২১০ কোটি টাকা আর আদানি হয়েছে ১৬১২ কোটি টাকা।

দেশের একটার পর একটা সরকারি সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে আদানি শিল্প গোষ্ঠীর হাতে। ইতিমধ্যে ১২টি সরকারি জাহাজ বন্দর এবং কয়েকটি বিমানবন্দর জলের দরে বিক্রি করা হয়েছে আদানিকে। এই সম্পদ কেনার জন্য আবার সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা নিগম এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সহ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

জীবন বিমা নিগম আদানি গ্রুফ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০,১২৭ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে যার বর্দ্ধিত মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৬,১৪২ কোটি টাকা। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক একইভাবে ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বিনিয়োগ করেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য এই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান দীনেশ খাড়া  ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন এর পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর যে অসম্ভব গতিতে আদানির কোম্পানিগুলির শেয়ার মূল্য কমছে তাতে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে ক্ষতির মুখে পড়ছে, তার কোনও উল্লেখ এখনও পর্যন্ত সরকার করছে না।

সরকারি ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানিতে অর্থ গচ্ছিত রাখেন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের গচ্ছিত এই টাকা অবাধে লুঠ হচ্ছে। আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিজগুলির শেয়ার মূল্য রকেট গতিতে পতনের ফলে আসলে সাধারণ মানুষের সঞ্চিত টাকাই লুঠ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন সারদা- রোজভ্যালি সহ অনেকগুলি পঞ্জী কোম্পানিতে মানুষের গচ্ছিত টাকা লুঠ হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায়, তেমনভাবেই সরকারের ঘরে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের অর্থ লুঠ হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়।ঐ পঞ্জী কোম্পানিগুলি বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে তৃণমূলের সরকার গঠনের জন্য যেমন বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল, তেমনই ক্রোনি কর্পোরেট কোম্পানিগুলিও নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য অর্থ ব্যয় করে।

আদানির এই সর্বগ্রাসী লুঠের বিরুদ্ধে খুব স্বাভাবিকভাবেই নীরব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। লোকসভায় আদানিদের লুঠের বিরুদ্ধে বিরোধীদের বিক্ষোভ বা বিরোধী দলের সভায় অনুপস্থিত তৃণমূল সাংসদরা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই। এই রাজ্যে দেউচা পাচামীর ১০ হাজার একর জমি, তাজপুর পোর্ট সহ অনেক প্রকল্প আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার কারিগর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। এই জন্যই বিজেপি ৫,২৭০ কোটি টাকা নির্বাচনী তহবিলে পায় আর তার পরেই স্থান তৃণমূলের। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৫২৮.১৪ কোটি টাকা জমা হয়েছে তৃণমূলের তহবিলে ২০২২ সালে, যা গত বছর ছিল মাত্র ৪২ কোটি টাকা।

লুঠেরাদের প্রতিনিধি বিজেপি- তৃণমূল। নরেন্দ্র মোদী-মমতা বন্দোপাধ্যায় দেশ-রাজ্যের সাধারণ মানুষকে লুঠ করার অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছেন আজকের যুগের গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াদের আর তার বিনিময়ে এদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া আর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অর্থ যোগাচ্ছে এ যুগের জালিয়াতরা। এই জালিয়াতদের হাতেই আছে দেশের বেশিরভাগ টেলিভিশন- সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ। তাই বাটপারিয়াদের কাহিনী তেমনভাবে  প্রকাশিতও হয়না আর তার লুঠের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদও প্রতিফলিত হয়না বাজারী সংবাদমাধ্যমে।

ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে লুঠেরাদের রক্ষাকর্তাদের

এ যুগের বাটপারিয়াদের লুঠ বন্ধ করা যাবে না, বিজেপি-তৃণমূলকে ক্ষমতায় রেখে। তাই সম্মিলিতভাবে সব মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে হবে, বাটপারিয়াদের রক্ষাকর্তা বিজেপি-তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবার জন্য।

Comments :0

Login to leave a comment