Editorial

হিন্দুত্ব চর্চার আখড়া

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial


প্রসঙ্গ যাই হোক একদা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বলেছিলেন সব ব্যাদে (বেদে) আছে। অধুনা নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার সেটা মানুষের মগজে সেধিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। হিন্দুত্ববাদীদের কষ্টকল্পিত আদর্শে বেদই সব কিছুর উৎস এবং আশ্রয়। মানব সভ্যতার বিকাশের সুদীর্ঘ বিকাশে আজ পর্যন্ত যা কিছু উদ্ভাবন বা যা কিছু অর্জিত জ্ঞান তার সবটাই এসেছে বৈদিক ভারতের মাটি থেকে। এই হিন্দুত্ববাদীরাই দাবি করে বেদের যুগে নাকি ভারতে অত্যাধুনিক বিমানে মানুষ যাতায়াত করত। 

 

আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলি নাকি সবই বেদের যুগে ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সভায় দাবি করেছিলেন প্রাচীন ভারতে যে প্লাস্টিক সার্জারি এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা চালু ছিল তার প্রমাণ গণেশের দেহে হাতির মাথা বসানো। এমনকি এই দাবিও প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন যে প্রাচীন ভারত প্রজনন বিদ্যা ও বায়োটেকনোলজিতে উন্নত ছিল। প্রমাণ হিসাবে তিনি হাজির করেছিলেন কর্ণের জন্মকে। আজকের যুগের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেই নাকি কর্ণের জন্ম হয়েছিল যৌন সম্পর্ক ব্যতিরেকে। 

 

এই প্রধানমন্ত্রীই গত স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে দাবি করেছেন ভারত লোকতন্ত্র তথা গণ‍‌তন্ত্রের জননী। হিন্দুত্ববাদী আরএসএস’র উদ্যোগে কল্পিত ভারতীয়ত্বের পুনর্নির্মাণের প্রকল্পের একটা অংশকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তুলে ধরেছেন। বলতে চেয়েছেন আজকের আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত তা নাকি বেদের যুগে ভারতে ছিল। মোদী উত্থাপিত আরএসএস’র কথাকেই উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে ‌আলোচ্য বিষয় করতে নির্দেশ এসেছে ইউজিসি’র কাছ থেকে। শুধু তাই নয় হিন্দুতর্ববাদীদের কল্পিত ধারণা অনুযায়ী ভারতের ইতিহাস পুনর্নির্মাণের অনুষঙ্গগুলি থেকে বেছে বেছে ১৫টি চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে আলোচনাসভার আয়োজন করতে বলা হয়েছে। ইউজিসি’র নির্দেশ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের সংবিধানও নাকি লেখা হয়েছে বেদের প্রেরণায়। দাবি করা হয়েছে সমানাধিকারের প্রশ্নটিও নাকি বেদ থেকে পাওয়া।

 


সন্দেহ নেই দেশের উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্রগুলিকে অবৈজ্ঞানিক, যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন হিন্দুত্ব চর্চার আড়ায় পরিণত করতে চাইছে মোদীর সরকার। সেই গুরু দায়িত্ব বর্তেছে ইউজিসি এবং আইসিএইচআর’র উপর। একটি সংস্থা চর্চার আয়োজন করছে অন্যটি রসদ জোগাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী যেসব কষ্ট কল্পনা করে থাকে ইতিহাসের কোনও পর্যায়েই তার হদিশ নেই। তাই তারা বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি নির্ভর আধুনিক গবেষণা অঙ্গন থেকে ইতিহাস গবেষণাকে সরিয়ে পুরাণ মহাকাব্য নির্ভর কাল্পনিক ইতিহাস শেখাতে চায়। গণতন্ত্র আধুনিক সভ্যতার অবদান হলেও হিন্দুত্ববাদীরা তাকে বেদের যুগের বলে হাজির করতে চায়। গণতন্ত্র মানে নিছক সাধারণের মতামতের স্বীকৃতি নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদের অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও যুক্তিকে বাদ দিলে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। তেমনি বেদের ভিত্তিই বিভাজন। বৈদিক যুগ সমাজকে চতুরাশ্রমে বিভাজিত করে অধিকার কেড়ে নিয়েছে। সেই বেদ সমানাধিকারের ধারণা দিতে পারে না। প্রাচীন ভারতীয় অপবিজ্ঞান, কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্য থেকে আধুনিক ভারতীয় সভ্যতা গড়ে তোলার সোপান হিসাবেই আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধান রচনা করেছিলেন। আজকের হিন্দুত্ববাদীরা তাকে প্রাচীন পশ্চাৎপদতায় ঠেলে নামাতে সক্রিয়।

Comments :0

Login to leave a comment