অমিত শাহ হামেশাই ভুলে যান তিনি এখন ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তাই তাঁর আরএসএস-বিজেপি সত্তার আড়ালে চাপা পড়ে যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পরিচয়। সংবিধানে হাত রেখে শপথ নিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু পদে পদে সেই সংবিধানকে অবহেলা ও অশ্রদ্ধা করছেন হিন্দুত্ববাদী আত্ম পরিচিতি সত্তার প্রাবল্যে। ভারতের সংবিধান কোনও একটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্র ভাষা বলে স্বীকৃতি দেয়নি। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের এই দেশে ২২টি গুরুত্বপূর্ণ ভাষাকে সংবিধান স্বীকৃতি দিয়েছে। আর প্রশাসনিক যোগাযোগ ও সমন্বয়ের সুবিধার্থে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার গুরুত্ব পেয়েছে। সংখ্যার বিচারে দেশে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ হিন্দি ভাষায় কথা বলে মানে এই নয় বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দিকে সব ভারতবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে হবে। হিন্দি অবশ্যই গোবলয় বা হিন্দি বলয়ের ভাষা। আর সেখানেই আরএসএস-বিজেপি’র প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি। আবার এই গোবলয়েই ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের ছড়াছড়ি। হিন্দুত্ববাদের মূলভিত্তি যেহেতু যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান মনস্কতার বিপরীত মেরুতে তাই ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের আঁধারেই হিন্দুত্ববাদের রমরমা। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দির প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের দুর্বলতা প্রকট। হিন্দুত্ববাদীদের ধারণা হিন্দি ভাষাকে আশ্রয় করেই তাদের হিন্দুত্ববাদের ভারত সহজ হবে। এমন ভাবনার মূলে রয়েছে হিন্দু, হিন্দি, হিন্দু রাষ্ট্র বা হিন্দুত্ব। ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে থাকা আরএসএস’র আপাতত এটাই প্রধান লক্ষ্য ও করণীয়।
আরএসএস বৈচিত্রে বিশ্বাস করে না। বহুত্ব তাদের চোখের বালি। জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতির অফুরন্ত ভিন্নতা এবং তার মধ্যে সমন্বয়ের ধারাই ভারতে প্রকৃত ঐতিহ্য। সভ্যতার বিকাশের ধারা পথে এইভাবেই ভারতের সমাজ-সংস্কৃতির স্ফূরণ ঘটেছে। ভারত রাষ্ট্র এটাকেই তার সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আরএসএস এই ঐতিহাসিক ও পরম্পরাগত সত্য ও বাস্তবকে অস্বীকার করে। তারা একবগ্গা চিন্তার বাইরে নজর ফেলতে পারে না। তাই এক দেশ, এক ভোট, এক দল, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতির মন্ত্রে তারা দীক্ষিত। তারা মনে করে হিন্দু ছাড়া ভারতে অন্য ধর্মের জায়গা নেই। ভাষা হিসাবে একমাত্র হিন্দিই মান্যতা পাবে। আর সংস্কৃতি হিন্দু ধর্মের আধারের বাইরের কিছু গ্রহণ করা যাবে না।
মোদী সরকার আরএসএস’র এই মৌলিক অ্যাজেন্ডাকে সামনে রেখেই হিন্দি, হিন্দু, হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগতে চাইছে। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের যাবতীয় কাজে এবং প্রচারে হিন্দিকে যথাসম্ভব ব্যবহার করছে। যে রাজ্যে বিজেপি সরকার চালাচ্ছে সেখানে সর্বাত্মকভাবে হিন্দিকে চাপানো হচ্ছে। কেন্দ্রের শিক্ষানীতি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে সর্বত্র বিদ্যালয় শিক্ষায় হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করা যায়। অর্থাৎ হিন্দু রাষ্ট্রের কথা মাথায় রেখে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে জোর করে চাপানোর চেষ্টা চলছে।
অমিত শাহ বলেছেন এমন এক সমাজ তারা গড়ে তুলছেন যেখানে ইংরেজিতে কথা বলা লজ্জার বিষয় হবে। অর্থাৎ ইংরেজি বর্জনের পক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করেছেন। আড়ালে আছে হিন্দির আধিপত্য। ইংরেজিকে নস্যাৎ করা যায়, ইংরেজির ব্যবহার যদি কমিয়ে দেওয়া যায় তাহলে হিন্দির জন্য খোলা মাঠ মিলে যাবে। শাহ’র ইংরেজি বিদ্বেষ প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে। মাতৃ ভাষা হিসাবে কোনও ভাষাই ছোট নয়। ভারতে প্রায় ২০ হাজার ভাষা ও উপভাষা আছে। সব ভাষার আধারে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে। ভাষার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই। তাই সব আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্ব দেবার মধ্য দিয়ে বহুত্বের ভারতীয়ত্বকে চির ভাস্বর রাখতে হবে।
Editorial
বহুত্বের ভারতীয়ত্ব একবগ্গাদের নয়

×
Comments :0