২০২৩ সালে, দক্ষিণ কোরিয়া তার জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পথে একটি চমকপ্রদ নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে - দেশের উর্বরতার হার মহিলা প্রতি ০.৭২ সন্তানে নেমে এসেছে। একটি স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ২.১’র থেকে যা অনেকটাই নিম্মগামী যা আসন্ন সংকটের সংকেত দিচ্ছে দেশে। যদিও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক হ্রাসের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার লড়াই মারাত্মক, কিন্তু এটি অন্যান্য দেশ, বিশেষত ভারতের জন্য একটি প্রাথমিক স্তরের সতর্কতা হিসাবেও কাজ করে, যেখানে কিছুটা ধীরগতিতে হলেও সমানভাবে উদ্বেগজনক পথে রয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রজনন হার দ্রুত হ্রাস দেশটির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন নিছক সংখ্যার বিষয় নয়; এটি কর্মশক্তি এবং একটি বয়স্ক সমাজের মধ্যেকার রূপান্তরের ইঙ্গিতবাহী। একটি সঙ্কুচিত তরুণ জনসংখ্যা এবং একটি ক্রমবর্ধমান প্রবীণ গোষ্ঠী বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করবে।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতেও প্রজনন হার কমছে। ১৯৫০ সালে প্রতি নারীপিছু সর্বোচ্চ ৬.১৮টি সন্তান থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রজনন হার ১.২৯-এ নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বর্তমান হার ২.১ এর নিচে নেমে আসবে। যদিও ভারতের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের গতি দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় ধীর, তবুও প্রজনন হার হ্রাস উদ্বেগের একটি কারণ।
মোহন ভাগবতের মতো দক্ষিণপন্থী ভারতীয় নেতারা ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে তরুণ জনসংখ্যা ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান চালক, তবে যদি প্রজনন হার হ্রাস অব্যাহত থাকে তবে ভবিষ্যতে ভারতও একই ধরণের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
বেশ কয়েকটি কারণ ভারতের ক্রমহ্রাসমান প্রজনন হারে অবদান রাখছে, পরিবারগুলির পক্ষে সন্তান ধারণ করার বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তুলছে।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয় এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সন্তান নেওয়ার বিষয়টিকে আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। অনেক পরিবার ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল সমাজের চাহিদার সাথে সন্তান লালন-পালনের ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।
ভারতে ঐতিহ্যগতভাবে সন্তান লালন-পালনের জন্য বেশিরভাগ দায়িত্ব মহিলাদের উপর চাপিয়ে দিওয়া। যত বেশি সংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন এবং শিক্ষা ও কর্মজীবনের অগ্রগতির সন্ধান করছেন, তারা বিয়ে এবং সন্তান জন্মদানে বিলম্ব করছেন, যা উর্বরতা হ্রাসে আরও অবদান রাখছে।
যেহেতু বর্তমানে বিবাহের ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে এবং পরবর্তী জীবনে সন্তান ধারণ করার প্রবণতা আছে তাতে উর্বরতার হার স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাচ্ছে। একক ব্যক্তি কেন্দ্রিক পরিবারের সৃষ্টি এবং পারিবারিক কাঠামো এবং কর্ম-জীবনের ভারসাম্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও এই সংকটে অবদান রাখে।
বন্ধ্যাত্বের ক্রমবর্ধমান মাত্রা – জীবনযাত্রার পরিবর্তণের কারণগুলি, চাপ এবং পরিবেশগত প্রভাবগুলি দ্বারা চালিত - দম্পতিদের সন্তান ধারণ করা আরও শক্ত করে তুলছে, যা উর্বরতা হ্রাসকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
২০৫০ সালের মধ্যে ভারত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে, যেখানে প্রবীণদের সংখ্যা শিশুদের চেয়ে বেশি। এটি ভারতের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুযোগ-সুবিধাকে হ্রাস করবে, এবং এর অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোকেও টালমাটাল করে তুলবে। এই পরিবর্তনগুলি পরিচালনা করার জন্য অবিলম্বে হস্তক্ষেপ না করা হলে, ভারত দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মতো একই ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, যেখানে বয়স্ক জনসংখ্যা এবং সঙ্কুচিত শ্রমশক্তি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাধা দেবে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৪% বয়স্ক মানুষ কাজ করেন (মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে); তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি কাজ করেন ‘বাধ্য’ হয়ে, শ্রমের বয়স পেরিয়ে গেলেও। রাজ্যে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে করুণ অবস্থা হবে বয়স্ক বিধবা মহিলাদের, কারণ তাঁদের গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে অধিক, কিন্তু তাঁদের অর্থ উপার্জনের পরিধি সীমিত ও তাই পরিবারে তাদের কথার দামও সীমিত। ২০৩৬ সালে রাজ্যের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা কর্মক্ষম বয়সের মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যার চেয়ে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
২০১১ সালের জনগণনার তথ্যের নিরিখে কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৬ সালে রাজ্যের জনসংখ্যা ১০.০৫ কোটি হবে; যা ২০৩৬-এ ১০.২৯ কোটি হবে। অর্থাৎ, ১০ বছরে মাত্র ২৪ লক্ষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতো পশ্চিমবঙ্গেও আনুমানিক ২০৪৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যার বৃদ্ধির স্বাভাবিক হার (পরিযায়ী না হলে) শূন্য হয়ে যাবে। ২০২৬ সালে জনসংখ্যায় ৬০’ঊর্দ্ধ অনুপাত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে গড়ে ১৫% হলে পশ্চিমবঙ্গে তা হবে ১৩.৩%। ২০৩৬-এ পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাতটি বেড়ে দাঁড়াবে ১৮.৩%, অর্থাৎ প্রতি পাঁচ জনে কম-বেশি এক জন লোক ষাট বছরের বেশি। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরই বয়স হবে ৩৩.৯ বছরের বেশি। ২০৩৬ সালে এই সংখ্যাটি হবে ৩৮.৮ বছর। যে ১০ বছরের সীমার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময়কালে রাজ্যের প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায় কর্মক্ষম বয়সের উপরে নির্ভরশীল ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ১৯৭ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২৭৯। এবং, কর্মক্ষমদের উপরে যত অপ্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীল হবে, তার তুলনায় নির্ভরশীল ষাটোর্ধ্বদের সংখ্যা বেশি হবে। এক দিকে জন্মহারের দ্রুত পতন, অন্য দিকে প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার ফলেই এই ঘটনা ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গের নারীদের জনতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্য হল কম বয়সে বিবাহ (নাবালিকা বিবাহে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম), দ্রুত একটি বা দু’টি সন্তানের জন্ম দেওয়া, এবং তার পর নির্বীজকরণ বা অন্যান্য গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার।
Population Studies
হ্রাস পাচ্ছে ভারতে সন্তান উৎপাদনের হার
×
Comments :0