Farmer Suicide

গত দু’দিনে রাজ্যে আত্মঘাতী ৫ কৃষক

রাজ্য

ছবি- কৃষক জয়দেব সরকারের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ পরিবার। ছবি অভীক ঘোষ।


ফের ঋণের দায়ে কৃষক আত্মঘাতী। গত শনিবার রাত থেকে রবিবার বিকেল প্রর্যন্ত রাজ্যে পাঁচ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। এক অকাল বর্ষণের ধাক্কায় গত কয়েক ঘণ্টায় দক্ষিণবঙ্গের ৫ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। রবিবার সকালে আরামবাগের বাতানল গ্রাম পঞ্চায়েতের কাঁচগোড়িয়া গ্রামের জয়দেব সরকার(৭১) নামে এক কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তিনি প্রায় আট বিঘে জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। তার জন্য প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা ঋণ করেছিলেন বাতানল সমবায় সমিতি থেকে। কিন্তু এই অকালবৃষ্টিতে তার চাষের সমস্ত জমিতে জল জমে যায়। তা দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। এমনিতেই মাথায় প্রচুর দেনা। প্রায়ই তাগাদার মুখে পড়েন তিনি। ঋণ কি ভাবে পরিশোধ করবে তা ভেবেই পাচ্ছিলেন না। বাড়ির বাইরেই বেরোতেন না লজ্জায়। জন মজুরদের টাকাও কোথা থেকে দেবেন বুঝে পাচ্ছিলেন না। তিনি মানসিক ভাবে অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়লে তাঁর ভাইপো তাঁকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। 
রবিবার সকালে ভাইপোর বাড়িতেই চা খেয়ে বসে ছিলেন। এর পর অন্যান্য সদস্যরা নিজেদের কাজে এদিক ওদিক চলে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগেই তিনি সিলিং ফ্যানে গলায় গামছার ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েন। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। পরে পুলিশ গিয়ে দেহ উদ্ধার করেন। পারিবারে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁর ছেলে একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোন কাজ করতেই পারেন না। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। ঘটনার জেরে এলাকায় শোকের আবহ তৈরি হয়েছে।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিবিমা সহ কৃষক সহায়তা প্রকল্পগুলির মূল্যহীন আশ্বাসকে চোখের সামনে তুলে ধরছে কৃষকদের মৃত্যুর ঘটনা। সদ্য আলু লাগানো খেত নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়ায় হতাশায় শুক্রবার রাতে আত্মহত্যা করেছেন রূপ সনাতন ঘোষ। তাঁর বাড়ি পূর্বস্থলী থানার নিমদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছাতনি উত্তরপাড়ায়। মাইক্রোফিনান্সের চাপে হুগলীর ধনেখালির আরও একজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অতিবৃষ্টিতে ধানের জমি জলে ডুবে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেছেন হুগলীর খানাকুলের কৃষক তরুণ পালুই। 
শুক্রবার রাতে বর্ধমানের পূর্বস্থলী থানার নিমদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছাতনি উত্তর পাড়ায় আত্মহত্যা করেছেন রূপ সনাতন ঘোষ (৪৫)। তাঁর আলুখেত জলে ডুবে গিয়েছে।  চন্দ্রকোণার কৃষক বাপি ঘোষের জমির আলু বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনিও বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। তাঁর চিকিৎসা চলছিল মেদিনীপুর হাসপাতালে। সেখানেই শনিবার রাতে মৃত্যু হয় তাঁর। নিহত কৃষকৃর স্ত্রী ঝুমা ঘোষ জানিয়েছেন, ‘‘ঋণ নিয়ে চাষ করেছিল। জমির আলু বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি বিষ খান।’’

মাইক্রোফিনান্স সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় শনিবার সকালে ধনেখালি থানা এলাকার বেলমুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাবনান গ্রামের বাসিন্দা দিলীপ মালিক (৩০) গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ঋণের কিস্তির টাকা শোধ না করতে পারায় বাড়িতে কয়েকদিন ধরেই অশান্তি চলছিল। তার জেরেই এই আত্মহত্যা বলে মনে করছেন গ্রামবাসীরা। আত্মঘাতী দিলীপ মালিকের পরিবারে বাবা, মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। কিছুদিন আগে তিনি এক বেসরকারি মাইক্রোফিনান্স সংস্থা থেকে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এলাকায় ভদ্র ও সজ্জন বলে পরিচিত ছিলেন দিলীপ মালিক। তাঁর বাবার কিছু চাষের জমি আছে, সেখানেই চাষের কাজ করতেন। এবারে ধানচাষ করে লাভজনক দর পাননি। যার ফলে ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় চিন্তায় ছিলেন। এর আগে দু’সপ্তাহের কিস্তি মেটাতে পারেনি। শনিবার ছিল কিস্তি দেওয়ার তৃতীয় সপ্তাহ। বাড়িতে টাকা নেই, তার ওপর কিস্তি দিতে হবে, এই নিয়ে স্ত্রী’র সঙ্গে সকাল থেকেই ঝামেলা চলছিল। পরিবারের লোক হঠাৎই দেখতে পান আত্মহত্যা করেছেন তিনি।

অভিযোগ, কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে প্রশাসনের তরফে কৃষক আত্মহত্যার কারণ আড়াল করতে পারিবারিক কলহের গল্প সাজানোর চেষ্টা করছে। বর্ধমানের পূর্বস্থলীর কৃষক রূপ সনাতনের মৃত্যর খবরের বিষয়ে কালনা মহকুমাশাসক রূপম আগরওয়াল জানান, ‘‘আমি স্থানীয় প্রধানের মুখে আত্মহত্যার কারণ অন্য শুনেছি। উনি চাষ করতে গিয়ে নয়, পারিবারিক কারণেই আত্মহত্যা করেছেন।’’  আগেও দেখা গিয়েছে, ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটলেই সেখানে সরকারি তদন্তে অন্য রিপোর্ট উঠে আসে। বেশিরভাগ রিপোর্টেই বলা হয় যে, ঋণের দায়ে নয়, কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন পারিবারিক কারণে! 
রবিবার তৃণমূল মুখপাত্র কুনাল ঘোষের মুখেও একই সুর শোনা গিয়েছে। তিনি বলেছেন, কোনও কৃষিজীবি আত্মঘাতী হলেই তাকে কৃষক আত্মহত্যা বলা যায় না। কৃষির বাইরের কারণেও অনেকে আত্মঘাতী হন।
কৃষকসভার বক্তব্য, অকাল বৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখে এখনই পাশে দাঁড়ানো উচিত সরকারের। তার বদলে তৃণমূলের নেতারা চাষের সংকট মানতেই নারাজ। অথচ মৃত কৃষক পরিবারের সদস্যরাই ঋণগ্রস্ততার কথা জানাচ্ছেন। 

Comments :0

Login to leave a comment