Ram Constitution

রামের ছবিকে হিন্দু রাষ্ট্রের হাতিয়ার বানাতে চাইছেন মোদী? সংবিধানে আছেন আকবর, অশোক, টিপু সুলতানও

জাতীয়

সংবিধানের অলঙ্করণে রামের ছবি ব্যবহারকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার বানাতে চাইছেন মোদী? প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাম্প্রতিক ভাষণ দেখে এমনই প্রশ্ন উঠছে। রামমন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ অনুষ্ঠানের পরে রবিবার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী মোদী সংবিধানের অলঙ্করণে রামের ছবির ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজের মতো করে। উল্লেখ্য, ভারতের সংবিধানের ৭৫ বছর হতে চলেছে। এদিনের ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সেই কথাও বলেছেন মোদী। অতি কৌশলে এদিন তিনি সংবিধান থেকে রাম এবং রাম থেকে অযোধ্যায় রামমন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’য় চলে গেছেন। 

২০২৪ সালের প্রথম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে রবিবার মোদী বলেন, ‘‘ভারতের সংবিধানের ৭৫ বছর হচ্ছে এবং সুপ্রিম কোর্টেরও ৭৫ বছর হচ্ছে। আমাদের গণতন্ত্রের এই পর্ব ‘মাদার অব ডেমোক্র্যসি’ হিসাবে ভারতকে আরও শক্তিশালী করে। ভারতের সংবিধান এত গভীর মন্থনের সঙ্গে করা হয়েছে যে, একে জীবন্ত দলিল বলা হয়। এই সংবিধানের মূল দলিলটির তৃতীয় অধ্যায়ে ভারতের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের বর্ণনা করা হয়েছে। এটা খুবই আকর্ষণীয় যে তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই আমাদের সংবিধান নির্মাতারা ভগবান রাম, মাতা সীতা এবং লক্ষ্মণজীর ছবি দেওয়া হয়েছে। প্রভু রামের শাসন আমাদের সংবিধান নির্মাতাদের কাছে প্রেরণার স্রোত ছিল। সেই জন্যেই ২২ জানুয়ারি আমি অযোধ্যার ‘দেব থেকে দেশ’-এর কথা বলেছি। ‘রাম থেকে রাষ্ট্র’-এর কথা বলেছি।’’ 

উল্লেখ্য, ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করার পরে উপস্থিত কয়েক হাজার দর্শকের সামনে আধ ঘণ্টার বেশি ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানেও তিনি বলেন, ‘‘ভারতের সংবিধানের প্রথম পাতায় ভগবান রাম বিরাজমান। সংবিধান কার্যকরী করার পরেও রামের অস্তিত্ব নিয়ে আইনি লড়াই চালানো হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে। যারা ন্যায়ের মান রেখেছে। প্রভু রামের মন্দিরও ন্যায়বদ্ধ পদ্ধতিতেই হয়েছে।’’

সংবিধানে রামের ছবির অলঙ্করণের সঙ্গে তাঁকে কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্পর্ক নেই। বিশ্লেষকদের মতে, মোদী সংবিধানের মূল দলিলে রামের ছবি থাকাকে ব্যবহার করে সংবিধানের যে মূল ভাবনা তাঁকে খারিজ করার কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন। সংবিধান অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশের শাসকে কোনও ধর্মের প্রকাশ্য আচরণ বা সমর্থন করতে পারেন না। নিজেদের ব্যক্তিগত আর পারিবারিক ধর্ম যাই হোক, তাঁদের কোনও ‘সরকারি’ ধর্ম নেই। কিন্তু শুরু থেকে মোদী এই নিয়ম ভেঙেছেন পরিকল্পিতভাবে। শুধু রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় নন, দেশের মানুষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে কোনও কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র, হাসপাতাল উদ্বোধন করতে দেখেন না। সাগর থেকে হিমালয়— তাঁকে বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরে ধার্মিক পুজাঅর্চনাতে ব্যস্ত থাকতেই দেখেন। এখন রামের ছবি সংবিধানের অলঙ্করে আছে— এইকথা বার বার বলে তিনি এই সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বদলে একে হিন্দুত্বের সঙ্গে জুড়তে চাইছেন। যে কারণে তিনি এদিন বলেছেন,  ‘‘প্রভু রামের শাসন আমাদের সংবিধান নির্মাতাদের কাছে প্রেরণার স্রোত ছিল।’’ 

সংবিধানের একটি অধ্যায়ের অলঙ্করণে রামের ছবি দেখে যদি তাঁর এমন ধারণা হয়ে থাকে, তাহলে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন সংবিধানে গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, অশোক, আকবর, গান্ধীজী, সুভাষচন্দ্র বসুও আছেন। রানি লক্ষ্মী বাঈয়ের সঙ্গে আছেন টিপু সুলতানও। যাকে হিন্দুবিরোধী তকমা দিয়ে পাঠ্যসূচি থেকে সমস্ত জায়গা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে তাঁর দলের সরকার। 

সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায় হচ্ছে মৌলিক অধিকার। তার উপরে অলঙ্করণে রয়েছে রাম, সীতা এবং লক্ষ্মণ লঙ্কা জয় করে ফিরছেন। উত্তরাখণ্ড এবং তেলেঙ্গানা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রাঘবেন্দ্র সিং চৌহ্বান সংবিধানের অলঙ্করণ নিয়ে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, এর অর্থ এই নয় যে, সংবিধান ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে ভগবান রামের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। লঙ্কার রাজা রাবনকে হারিয়ে ভগবান রামের অযোধ্যা ফেরাকে এখানে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয় হিসাবে দেখানো হয়েছে। রাজনৈতিক অর্থে এই ছবি বলতে চেয়েছে রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মৌলিক অধিকারের জয়ের কথাই। কিন্তু সীতার মতই মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সরকার এবং বিচারবিভাগের ভূমিকার কথাই বোঝানো হয়েছে রাম-লক্ষ্মণের মাধ্যমে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চৌহ্বান সংবিধানের অলঙ্করণের এই ব্যাখ্যা এখন প্রধানমন্ত্রী মোদী বলার পরে দিচ্ছেন না। এক বছর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ওয়েব পোর্টাল ‘দ্য লিফলেট’-এ তিনি একটি নিবন্ধে এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। 

ভারতীয় সংবিধান যখন ছাপার জন্য প্রস্তুত, তখন জওহরলাল নেহরু প্রস্তাব দেন, সংবিধানের প্রথম দলিলটি হাতে লেখা হবে। প্রাচীন ভারতের পুঁথির মতো তার পাতাগুলিতে থাকবে ছবি এবং নকশার অলংকরণ। সেই দায়িত্ব পড়েছিল নন্দলাল বসুর কাঁধে। সম্পূর্ণ সংবিধানটি হাতে লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই সময়ের প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফি রাইটার বা লিখন শিল্পী প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদাকে। ২৫১টি পার্চমেন্ট কাগজে লেখা এই পাণ্ডুলিপির ওজন দাঁড়িয়েছিল ৩ কিলো ৭৫০ গ্রাম। নেহরুর নির্দেশেই রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে আসেন প্রেমবিহারী নারায়ণ। আলোচনা করেন নন্দলাল বসুর সঙ্গে। কলাভবনের পড়ুয়াদের সঙ্গে নিয়ে এই বিশাল কাজে হাত দেন নন্দলাল বসু। সংবিধানকে অলঙ্কৃত করতে মোট ২২টি ছবি এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু ও তাঁর সহকারীরা। সংবিধানের প্রথম প্রচ্ছদের যে ছবি সেটা অজন্তার গুহাচিত্রের ভিত্তিতে আঁকা। তাতে পদ্মের ছবিও আছে। কিন্তু সেটাকে এখন বিজেপি’র বা হিন্দুত্বের প্রতীক বলে দাবি করা হলে যেমন হবে, রামের চিত্রাঙ্কন নিয়ে মোদীর দাবিও তেমনই। প্রস্ফুটিত পদ্ম শুধু হিন্দু ধর্মের নয়, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রথম অধ্যায়ে ব্যবহার করা হয়েছে সিন্ধু সভ্যতার শীলমোহরের ছবি, যেখানে ষাঁড়ের ছবি আছে। এটাকেও এখন হিন্দুত্ববাদীরা শিবের বাহন বলে দাবি করতে পারে। তিন নম্বর অধ্যায়ে যেমন রাম-সীতা-লক্ষ্মণের ছবি আছে, চার নম্বর অধ্যায়ে আছে মহাভারতের কৃষ্ণ-অর্জুনের ছবি। পাঁচ নম্বর অধ্যায়ে বুদ্ধ, ছয়ে মহাবীর, সাতে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করছেন। নবম অধ্যায়ে বিক্রমাদিত্যের রাজসভার ছবি যেমন আছে, তেমনই দ্বাদশ অধ্যায়ে নটরাজ এবং স্বস্তিক আছে। চৌদ্দতম অধ্যায়ে আছে সম্রাট আকবরের দরবার। একমাত্র মহিলা ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে সংবিধানের অলঙ্করণে আছেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ। তাঁর সঙ্গে একই পাতায় আছেন টিপু সুলতানও। ফলে মোদী বারে বারে রামের ছবিকে বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করে এই সংবিধানকে ‘হিন্দু’ চরিত্র দেওয়ার যে চেষ্টা করছেন, বাস্তবে তা নয় ।

Comments :0

Login to leave a comment