Sandeshkhali Villagers

‘শয়তান’দের সামনে লড়তে অটল গরিব ঘরের মহিলারা

রাজ্য

চন্দন দাস ও প্রবীর দাস: সন্দেশখালি 
 

 ‘খেলা হবে।’ সন্দেশখালিতে হুমকি দেওয়া শুরু করেছে তৃণমূল। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার ঘুরে যাওয়ার পর দ্বীপাঞ্চলে নড়াচড়া শুরু করেছে মমতা ব্যানার্জির দলের ঘৃণিত কর্মীবাহিনী।
দ্বারির জাঙ্গালের সনকা সর্দার সোমবার জানালেন,‘‘বেশ কিছুদিন চুপচাপ ছিল ওরা। কয়েকদিন হলো বাজারে মুখ খুলতে শুরু করেছে। বাজারে গেলে পাশ থেকে বলছে,‘যেগুলো সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলেছে তাদের সঙ্গে এক খেলা খেলে নেব। দিন আসছে।’’
তবে মহিলারা প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। প্রমাণ সোমবারের বেড়মজুর ১নং পঞ্চায়েতের পোলপাড়ায়। তৃণমূলের শঙ্কর সর্দারের বাড়ি ভাঙচুর করেন গ্রামবাসী মহিলারা। শঙ্করও অনেক অত্যাচার চালিয়েছে, এমনই অভিযোগ তাঁদের। পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে যায় শঙ্করকে রক্ষা করতে। চঞ্চলা সর্দার, সূর্যমণি সর্দার, অষ্টমী সর্দার, আরতি সর্দার, রমণী সর্দার, কাজলমণি সর্দার সহ ৯জন আদিবাসী মহিলাকে সেখান থেকে আটক করে পুলিশ।
দ্বারির জাঙ্গালেও সেই ছবি। লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া তাপসী সর্দাররা। 
দ্বারির জাঙ্গাল লাগোয়া ছোট কলাগেছিয়া নদী। ব্রিটিশ নাম দিয়েছিল দ্বারির জাঙ্গাল। তাই ‘জাঙ্গাল’ই চলছে। লোকে তাই বলেন। রাস্তার ধারের শিলাতেও সেই নাম। ব্রিটিশ চলে গিয়েছে। জমিদাররা জমিজমার আশা ছেড়ে শহরেই রয়ে গিয়েছেন। নদীর পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও ‘জঙ্গল’ হয়নি। তবে জঙ্গলরাজ কায়েম হয়েছে— মমতা ব্যানার্জির শাসনে। 
সেই জঙ্গলরাজের স্থানীয় মাথা শেখ শাহজাহান। আনন্দ সর্দারের কথায়,‘‘শাহজাহানের চেলাচামুন্ডা হলো ওই শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার। আরও আছে। আমাদের এখানে এখনও আছে। চারিদিকে নজর রাখছে। গত দু’দিন নড়াচড়া শুরু করেছে।’’
দ্বারির জাঙ্গালে তৃণমূলের সাপের মতো আপাতত টিকে থাকা দু’জনের কথা বললেন সর্দারপাড়ার মহিলারা। ঊর্মিলা সর্দার বললেন,‘‘রাজকুমার সর্দার আর বদন সর্দার। এখন আবার কথা বলতে শুরু করেছে। আমাদের সব নিয়েছে। জমি, একশো দিনের টাকা, ঘরের টাকা, এমনকি সম্মানও। ওদের ছেড়ে দিতে পারবোনি। ছাড়বোনি।’’
সাহস ধরে রেখেছে গ্রাম। কিন্তু পুলিশের ভরসায় মাথা তোলার চেষ্টা করছে সরীসৃপ। এবং তা শুরু হয়েছে রাজীব কুমার ঘুরে যাওয়ার পর। 
প্রমাণ মিলল থানায়। এদিন সারা ভারত কৃষকসভা এবং পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সন্দেশখালি দ্বীপের বেশ কয়েকটি গ্রামে যান। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রীর বাহিনী কৃষকের থেকে জমি কেড়ে ভেড়ি বানানোর পর গ্রামের কী কী বদল ঘটেছে, কতজমি দখল হয়েছে, কাজের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে, কী ভাবে জমি দখল হয়েছে— এমন নানা বিষয় তাঁরা জানার চেষ্টা করেছেন। বেশ কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা ব্লক ভূমিসংস্কার আধিকারিকের দপ্তরে ৬ দফা দাবিতে ডেপুটেশন দিয়েছেন। তারপর থানায় গিয়েছিলেন।
সন্দেশখালি থানাতেই বোঝা গেল তৃণমূল ফণা তোলার ভরসা কোথায় পাচ্ছে।
সন্দেশখালি থানায় দু’ধরনের পুলিশ এখন। একদল আগে থেকেই আছেন। তারা শাহজাহান-বাহিনীর পাশবিক অত্যাচার, নোংরামো দেখেছেন। গ্রামবাসীদের রুখে দাঁড়ানোর পরে এই পুলিশকর্মীরা কিছু ব্যাকফুটে আছেন। আড়ালে কথা বলার সুযোগ পেলে তাদের কয়েকজন বলছেন,‘‘নাম লিখবেন না প্লিজ। খুব অত্যাচার হয়েছে মানুষের উপর। এর বেশি কিছু বলছি না।’’ এছাড়া বাইরে থেকে কিছু পুলিশের মাঝারি, ছোট মাপের অফিসারকে পাঠানো হয়েছে। এগুলি মূলত ‘তৃণমূলের পোস্টিং।’ তেমনই এক অফিসার এদিন থানার মধ্যে কৃষকসভা, খেতমজুর ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলেন। বোঝানোর চেষ্টা করলেন— জোর করে জমি দখল করে ভেড়ি বানিয়ে শাহজাহানের বাহিনী বিশেষ খারাপ কিছু করেনি!
এই বাহিনী ‘টনিক’ পেয়েছে মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে রাজ্য পুলিশের ডিজি সন্দেশখালিতে ঘুরে যাওয়ার পর।
কতদূর স্পর্ধা বেড়েছে পুলিশের? মানুষের, বিশেষত মহিলাদের রুখে দাঁড়ানোর পরও? প্রমাণ ধীরুবালা সরদার। তিনি তাঁর অভিযোগপত্রে ‘সর্দার’ বানান এমনই লিখেছেন। তাঁদের জমি নিয়ে অভিযোগ আছে। হাকিম সরদার, ধনঞ্জয় সরদারদের বিরুদ্ধে মণিপুর পঞ্চায়েতের ওই মহিলার অভিযোগ। থানায় অভিযোগ জমা দিয়েছেন ধীরুবালা সরদার— সোমবার। থানা সেই আবেদনে কোনও সই, সিলমোহর মারতে অস্বীকার করেছে!
এই যখন সন্দেশখালির অবস্থা তখনও পুলিশের দুঃসাহস যায়নি। আর তারই উপর ভরসা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা মহিলাদের সুযোগ পেলেই হুমকি দিচ্ছে তৃণমূলের ‘শয়তান’রা। গ্রামবাসীরা তৃণমূলীদের এখন এই নামেই ডাকছেন।
তৃণমূলের এই সাহসের কারণ কী? সোমবার দেখা গেল, সন্দেশখালির নদীর এপারে, মূল ভূখণ্ডের ধামাখালিতে অটো, টোটোর সামনে সাদা কাগজে পোস্টার সাঁটা হয়েছে। ছোট কাগজে লেখা পোস্টার। কাদের পোস্টার, তার উল্লেখ নেই। কিন্তু পোস্টারের বয়ান দেখলে বোঝা যাচ্ছে, যারা ফনা তোলার চেষ্টা করছে ফের, সেই ‘শয়তান’দের পোস্টারদের। লেখা আছে—‘ইডি, সিবিআই লাগিয়ে সেখ শাহজাহানের মতো জননেতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায় না।’’
যে তৃণমূল নেতা ৫২দিন পলাতক, তার পক্ষে পোস্টার, তাও আবার সন্দেশখালিতে। অটো, টোটো চালকরা পোস্টার সাঁটাতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ— তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, ‘যদি পোস্টার না লাগাস, শাহজাহান ফিরলে কিন্তু দেখে নেব।’ এমন পোস্টার রবিবারও ছিল না।
সেখ শাহজাহানের নামে, বেনামে বিস্তর সম্পত্তি সন্দেশখালি থেকে সরবেড়িয়া, মিনাখাঁ থানা এলাকার মালঞ্চ এলাকায় ছড়িয়ে আছে। অনেকগুলি গেস্টহাউস, বাজার, বাড়ি আছে তার। ভেড়ি, জমি তো অনেকই। সন্দেশখালিতে এখন জমির অনেক কাজ হচ্ছে। সন্দেশখালি ২নং বিডিও অরুণ সামন্ত সোমবার সন্ধ্যায় জানিয়েছেন,‘‘এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০০জনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি।’’ ব্লক ভূমিসংস্কার আধিকারিকের কাছেও অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, সন্দেশখালিতে জেরক্স, কম্পিউটার থেকে নথি বের করে প্রিন্ট করার দোকানগুলিতে এখন ভিড় লেগেই থাকছে। এমন সময়ে বেশ কিছু সম্পত্তির মালিকানা বদলেরও কাজ হচ্ছে বলে একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে।
এদিন সন্দেশখালিতে গেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি বিপ্লব মজুমদার, সম্পাদক অমল হালদার, সংগঠনের নেতা সঞ্জয় পূততুন্ডু,  পরেশ পাল, মোহম্মদ সেলিম গাইন, অলোক ভট্টাচার্য, পঙ্কজ ঘোষ, সন্তোষ ব্যানার্জি, ইমতিয়াজ হোসেন, পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর ইউনিয়নের সভাপতি তুষার ঘোষ, সম্পাদক শক্তি মুখার্জি প্রমুখ। তাঁদের উত্থাপিত দাবিগুলির মধ্যে আছে জোর করে কেড়ে নেওয়া জমি অবিলম্বে পাট্টাপ্রাপক, বর্গাদার, রায়তী গরিব কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে হবে, মাছের ভেড়িতে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরাতে হবে,  বাকিদের লীজ বাবদ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, একশো দিনের বকেয়া মজুরির টাকা দিতে হবে  মহিলাদের উপর নির্যাতনকারীদের শাস্তি দিতে হবে প্রভৃতি। 

Comments :0

Login to leave a comment