রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আধা সামরিক বাহিনী থাকবে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা চূড়ান্ত।
এই বিষয়ে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এদিন বলেন, ‘‘রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য সরকার দু’গালে দুটো চড় খেয়েছে। এখন কোনও টালবাহানা চলবে না। এখন শুনছি এক জেলায় এক কোম্পানি বাহিনীর কথা। সে সব নয়। পর্যাপ্ত আধা সামরিক বাহিনী যাতে আসে, তাদের যথাযথভাবে যাতে ব্যবহার করা হয় সেদিকে লক্ষ্য দিতে হবে। ইতিমধ্যেই ৭টি প্রাণ গেছে। আধা সামরিক বাহিনীকে যথাযথ ব্যবহার করে, দলীয় কাজ থেকে রাজ্য পুলিশকে নিরস্ত করে ভোটদাতা, ভোটকর্মী, প্রার্থী এবং মানুষের মধ্যে ভরসা ফিরিয়ে আনবে কমিশন এবং সরকার এই আশা করছি। আমাদের পার্টির কর্মীরা সাহসের সঙ্গে মানুষের অধিকার রক্ষায় এবং জনগণের পঞ্চায়েত গড়ার যে সংগ্রামে আছেন, থাকবেন।’’
কী করছেন পার্টির সেই কর্মীরা?
আধা সামরিক বাহিনী আসছে। কী মনে হয়? রঞ্জিৎ পাল দাসপুরের একটি সভা থেকে সদ্য বেরিয়েছেন। যুবক রঞ্জিৎ আর একটি বুথের কাজে যাবেন। হাঁটছিলেন। প্রশ্ন শুনে দাঁড়ালেন। বললেন,‘‘আমরা কারও ভরসায় নাই। আমাদের দমেই আমাদের লড়ব। মানুষের ভালো সাড়া। তাঁরাই ভরসা। তবে আশা করব মানুষের নিরাপত্তা, সুষ্ঠু ভোটের জন্য আধা সামরিক বাহিনী কাজ করতে পারবে।’’
রঞ্জিতের কথাই অনেকের মুখে। যেমন রেজিনা খাতুন। উস্থি পঞ্চায়েতের প্রার্থী ২১বছরের এই যুবতী। সোজা কথা তাঁরও — ‘‘পার্টির ছেলেরা বুথ পাহারা দেবে। আমাদের লড়ে যাওয়ার উপরেই মানুষের ভোট দেওয়া অনেকটা নির্ভর করবে। আধা সামরিক বাহিনীকে দিয়ে যদি ঠিকঠাক কাজ করতে দেওয়া হয়, যদি মানুষ ভোট দিতে পারেন, তৃণমূলের গুন্ডামি আটকায়, তাহলে তো ভালোই। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব তাতে কমবে না।’’
সবই অভিজ্ঞতার ফল। কিছু দেখা। কিছু শুনে বোঝার।
আধা সামরিক বাহিনী এর আগে এসেছিল। কিন্তু তারা বসেছিল। তাদের বসিয়ে রেখেছিল পুলিশ, তৃণমূলের নির্দেশে। দেদার বুথ লুট করেছিল তৃণমূল।
অভিজ্ঞতা — ২০১৩-র।
সেবারও নির্বাচনের আগেই অনেক আসন দখল করেছিল মমতা ব্যানার্জির দল। পঞ্চায়েতের ৪৮৮০০টি আসনের মধ্যে ৫৩৫৬টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৯২৪০টি আসনের মধ্যে ৮৭৯টি এবং জেলা পরিষদের ৮২৫টি আসনের মধ্যে ১৫টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছিল তৃণমূল। তারপরও যেগুলিতে নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলিতেও দেদার ছাপ্পা, ভোট লুট করেছিল তারা।
আধা সামরিক বাহিনীকে কাজই করতে দেয়নি পুলিশ।
তবে সেবার, দখলের ভোটে সতেরোটার মধ্যে চারটি জেলা পরিষদ দখল করতে পারেনি তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৯% আসনে তৃণমূল হেরে গেছিল, দেদার ছাপ্পা, ভোট লুটের পরেও। বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছিল ১৫,৫৯৩টি আসনে। শতাংশের বিচারে ৩২%। কংগ্রেস ৫৫০৬টি আসনে। শতাংশের বিচারে ১১%।
ভোট হলে, মানুষ ভোট দিতে পারলে তারা হারবে — তৃণমূল সেবারই বুঝেছিল। দশ বছর পরে, এখন মমতা ব্যানার্জি এই বিষয়ে নিশ্চিত। তাই এবার আধা সামরিক বাহিনী, নিরাপত্তার আয়োজন নিয়ে এত গড়িমসি রাজ্য সরকারের।
এই প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম এদিন বলেছেন,‘‘নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এটা আমরা বারবার বলে আসছি। আর আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। পুলিশকে যেভাবে দলদাস হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এই সময়কালে যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, এমনকি আজ পর্যন্ত যেভাবে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তাতে রাজ্য পুলিশের যোগ্যতা, দক্ষতা প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। তারপরও দলীয় কাজে ব্যস্ত পুলিশের একটি বড় অংশের অফিসার। নির্বাচনে বাহিনী সাধারণত চাওয়া হয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। এবারে রাজ্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশন বাহিনী না দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেন। সুপ্রিম কোর্টে দু’পক্ষ দু’গালে দুটি চড় খেলো।’’
যদি আধা সামরিক বাহিনী যথাযথ ভূমিকা পালন করার সুযোগ পায়, তাহলে মানুষের পক্ষে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া সম্ভব হবে কিছুটা। যদি তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে না দেওয়া হয়— তাহলেও তৃণমূল এবং বিজেপি’র কব্জা থেকে বুথ রক্ষার লড়াই আরও মরিয়া থাকবেন লাল ঝান্ডার কর্মীরা।
সাহস তাঁরাই। ভরসা মানুষ।
সেই সূত্রেই আর একজনের কথা মনে রাখতে হবে। তিনি তখন রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী। মমতা ব্যানার্জির গুরুত্বপূর্ণ হাত। তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের একটি সভায় সিপিআই(এম) সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। কোন অসুখের কী ওষুধ আমি জানি। আমি নন্দীগ্রাম করেছি, আমি জঙ্গলমহলেও করেছি। এটা কীভাবে করতে হয় আমি জানি।’’ কে এই ‘ডাক্তার’? আজ তিনি বিজেপি’র নেতা — শুভেন্দু অধিকারী। এখন তিনি আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের দাবিতে রোজ ‘বাইট’ দিচ্ছেন। সেদিন যখন ‘গণতন্ত্রের ধর্ষণ’ হচ্ছিল তিনি কী কী করেছেন আগে, তার বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলেন — গর্বের সঙ্গে।
সেদিন যাঁরা লড়েছিলেন বুথ রক্ষায়, মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার নিয়ে সেদিন রাজভবন থেকে বেরনোর পর মীরা পান্ডেকে শুভেন্দু অধিকারীর সেই মারাত্মক, হিংসায় উসকানি দেওয়া মন্তব্য এবং মমতা ব্যানার্জির নানা হুমকি প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন,‘‘আমি সব জানিয়েছি রাজ্যপালকে।’’
রাজ্যপাল কিছু করেননি।
তবে মানুষ তাঁদের পক্ষে যতদূর সম্ভব তা করেছিলেন। সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলির কর্মীরা? লড়েছিলেন। বুথ আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত। তার ফল মিলেছিল রেজাল্টে।
Salim central force
বুথ রক্ষায় ভরসা মানুষের বাহিনীতেই
×
Comments :0