Sunday Story

পল্টু যেবার ভূত দেখল

ছোটদের বিভাগ

Sunday Story

সন্দীপ জানা

পল্টুদের গ্রামে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে প্রত্যেক ঘরে টিম টিম করে জ্বলে ওঠে কেরোসিনের ল্যাম্পগুলো। জ্যোৎস্নারাত ছাড়া বাকি সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে থাকে পথঘাট। একটানা চলতে থাকে ঝিঁঝির ডাক, থেকে থেকে হঠাৎ শেয়ালগুলো দলবেঁধে অট্টহাস্য করার মতো ডেকে ওঠে। এমনই এক সন্ধ্যায় ওরা গোপাল মাস্টারের বাড়ি পড়তে যাচ্ছিল। ওরা মানে পল্টু মানিক রাজা, দীপু। হঠাৎ একটা ঝাউগাছ বেয়ে তরতরিয়ে লাল বিন্দুর মতো কি একটা উঠতে দেখে পল্টু থমকে দঁড়াল। সে বাকিদেরকে সেটা দেখাতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সেটা উধাও। চোখের ভুল হতে পারে ভেবে সে আবার হাঁটতে লাগল। খানিকবাদেই সেটা আবার চোখে পড়ল। না, চোখের ভুল নয়, ওই যে এবারে সেটা বড় একখান ইউক্যালিপটাস গাছ বেয়ে নীচে নামছে। জিনিসটা এখন বাকিদের চোখেও পড়েছে।

কিন্তু সেটা যে কিসের আলো তা নিয়ে ওরা মুশকিলে পড়ল। কোনো পোকামাকড়ের আলো? নাহ। এমন লাল আলো-ওয়ালা কোনো পোকামাকড়ের কথা তো তারা কেউ শোনেনি। সাপের মাথার মনি-টনির কথা তারা শুনেছে অবশ্য। সে-সব কিছু? নাকি...। পল্টু সবার চেয়ে বয়সে ছোট, সুতরাং বাকিদের চেয়ে তার কৌতূহল ও ভয় দুটোই বেশি। সে সবার যুক্তি, মতামত শোনে, কিন্তু কিছুই যখন কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, সে ভয়ে ভয়ে বলল, ও দীপুদা, ভূত-টুত নয় তো?

দীপু মুখ ভার করে জবাব দিল, ‘তাই হবে নিশ্চই, না হলে এমন ...’। মানিক বলল, ‘আমার মনে হয় এটা পল্টুর দাদুর ভূত। দাদু মারা গেল এখনও তিন মাসও হয়নি। মারা যাবার এক বছর পর্যন্ত নাকি অনেকে এরকম ভূত হয়ে ঘোরে’। ভয়ে পল্টুর গলা শুকিয়ে কাঠ, ঘামে জামা ভিজে একসা। গোপাল মাস্টার হাতে কঞ্চিটা নাচাতে নাচাতে পড়া ধরছিল, ‘বল পল্টু, কীট আর পতঙ্গের মধ্যে পার্থক্য কি’?
উত্তর দেয়ার বদলে সে আমতা আমতা করে বলল, ‘আসার সময় রাস্তায় ভূত দেখলাম, লাল চোখ জ্বেলে তরতর করে গাছে উঠছিল...’ ।

ফাঁকিবাজ হিসেবে পল্টুর বেশ বদনাম আছে, টিউশনে পড়ার সময় নানা গল্প ফেঁদে পড়া পণ্ড করার একটা বিশেষ ক্ষমতা তার আছে।
গোপাল মাস্টার ঘা কয়েক কষিয়ে দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, “ ভূত দেখে এলেন উনি। মেরে ভূত ভাঙিয়ে দেব। হতচ্ছাড়া। ফাঁকিবাজির একটা সীমা থাকে, তোর কাছে তা নেই দেখছি ”।
ঠ্যাঙ্গানি খাওয়ার ভয়ে রাজা, মানিক, দীপু- সবাই চুপ করে রইল। বাকি সময়টা পড়ায় পড়ায় চাপা পড়ে গেল।

ছুটির পরে বাড়ি ফেরার সময় সেই অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় এসে আবার সেই লাল আলোটা চোখে পড়ল সবার। তারা যেখানে থমকে দাঁড়িয়েছে তার ঠিক আট-দশ হাত দূরে লাল আলোর কিছুটা কি ভাবে পড়েছে। দীপু, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “পল্টু, তোর দাদু। হঠাৎ কি মনে করে পন্টু ‘রাম রাম - হরি হরি বলে রাস্তার ওপর সটান শুয়ে পড়ে একটা প্রণাম ঠুকে নিল, আর ওমনি আশ্চর্য ব্যাপার, ভূত উধাও। তারপর খানিকক্ষণ পর একই জিনিস, পন্টু আবার সে-ভাবে প্রণাম ঠোকে আবার ভূত উধাও। তারপর এক সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটল। ভূতটা এবারে এসে বসল একেবারে পন্টুর গায়ের ওপর। বাপরে, বলে হাউমাউ করে পল্টু লাফিয়ে উঠে প্রাণপণে গা থেকে সেটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। ভূতটা কি এবার পল্টুর ঘাড় মটকাবে নাকি। বাকিরা ভয় পেয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করে, পল্টুও চিৎকার করে রাম নাম জপতে জপতে দৌড় লাগায়। তার চপ্পলের ফিতে, জামার বোতাম সব কোথায় ছিঁড়ে পড়ে রইল তার তখন হুঁশ নেই। রাতে পল্টুর ভাল করে ঘুম হল না, থেকে থেকে চমকে উঠে বিছানায় উঠে বসে। ভূতে তাড়া করেছিল বললে বাবা বিশ্বাস করে না।

পরেরদিন দিনের আলো থাকতে থাকতে পন্টুরা গোপান মাস্টারের বাড়ি পৌঁছে গেল। ছুটি হতে রাত হয়ে গেল। তারা গিয়ে গোপাল মাস্টারকে ধরল, তাদেরকে ওই ফাঁকা জায়গাটা পার করে দিয়ে আসতে হবে। গোপাল মাস্টার হাত পা নেড়ে বলল, ‘আরে ও-সব ভূত-টুত কিছু নয়, কোনো ভয় নেই। এতজন আছিস ভয় কিসের...’। মুখে ভয় কিসের বললেও গতরাতের ঘটনাটাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছে না। সেই ফাঁকা রাস্তায় এসে তারও গা’টা কেমন ছমছম করছে। কারও মুখে সাড়া শব্দ নেই। হঠাৎ রাস্তার সামনে থেকে সেই লাল আলো একটা তালগাছ বেয়ে গাছের একেবারে মাথায় গিয়ে মিলিয়ে গেল। সবাই একবাক্যে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই তো... ওই যেন। তারপর গতরাতের মতো নানান ভূতুড়ে ব্যাপার শুরু হল। একসময় আলোটা গিয়ে একটা ঝোপের ওপর স্থির হল। সাবাই বিড়বিড় করে রাম নাম জপতে শুরু করেছে। গোপাল মাস্টারের গলা শুকিয়ে কাঠ। 

এ-ধরণের আলো কিসের হতে পারে তার মাথায় আসছে না। তার টর্চের ম্যাড়মেড়ে আলোটা ঝোপের ওপর ফেলল, কিন্তু ভূতের সেখান থেকে নড়বার নাম নেই। হঠাৎ সাংঘাতিক কান্ডটা ঘটল। ঝোপটা প্রথমে একটু নড়ে উঠল, তারপর হুড়মুড়িয়ে কি একটা সেটার ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল। ওরে বাপরে। বলে যে যেদিকে পেরেছে দৌড় দিয়েছে। গোপাল মাস্টার হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় পড়েছে। তার নকল দাঁতকপাটি খুলে গিয়ে কোথায় পড়েছে ঠিক নেই। ফোকলা মাড়িতে গোঙাতে গোঙাতে সে কি বলছে বোঝা যায় না। দীপু আর হাসি চাপতে না পেরে হাঃ হাঃ করে হেসে একেবারে লুটোপুটি। ঝোপের ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে শেয়ালটা ততক্ষণে ডাকতে শুরু করেছে। পরে জানা গেল ভূত-টুত কিছু নয়, ওটা ছিল একটা লেজার লাইট। জিনিসটা দেখতে অনেকটা পেনসিল ব্যাটারির মতো। 

হাতের মুঠোয় রেখে সেটার আলো যেখানে খুশি ফেললেও আলোটা কোথা থেকে আসছে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই। জিনিসটা সেবার বাজারে সবে এসেছে। বাজারে সদ্য আমদানি হওয়া জিনিস নিয়ে কেরামতি দেখানোর লোভ কি আর সহজে সামলানো যায়। সুতরাং যা হবার হল, দীপু আজ বেশ কয়েকদিন গোপাল মাস্টারের ত্রিসীমানায় ঘেঁসেনি।

 

Comments :0

Login to leave a comment