Panchayat special

খোঁজ নেই ছেলের, মাকে প্রার্থী করেই ‘সমবেদনা’

রাজ্য

পীযূষ ব্যানার্জি: হরিপাল 

 

চড়া সুদে টাকা ধার করে ছুটে গেছেন বালেশ্বর। বালেশ্বর থেকে কটক, ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে দিনভর ঘুরে বেরিয়েও পাননি খোঁজ। 
ফিরে এসেছেন বাড়ি। এলাকার থানা। বিধায়কের বাড়ি দৌড়ে গেছেন। আবার যেতে হয়েছে ভুবনেশ্বরে। রক্ত দিয়ে এসেছেন মা। অশনাক্ত মৃতদেহের সঙ্গে যদি মিলে যায় ‘ডিএনএ’। পাঁচ দিনের মাথায় খবর আসবে, জেনে বসে আছেন মা। কোনো খবর আসেনি। রেলের অফিস থেকে দু’বার ফোন এসেছিল। জানতে চেয়েছিল, কোনো খোঁজ পেয়েছেন কিনা। 
নিশিদিন শুধু পথপানে চেয়ে বসে আছে এক আদিবাসী পরিবার। শুকিয়ে গেছে আঁখিজল। দিন যায়, রাত যায় করে একে, একে সব আশা ঝরে যাচ্ছে। নিরন্ন পরিবারে নিখোঁজ যুবকের বৃদ্ধা ঠাকুমা বলছেন, ‘‘আমার নাতি তো হরিপাল আর শেওড়াফুলির বাইরে এতদূর কখনও দেখেনি। ও যেন কেন এতদূর যেতে গেল!’’ 
গোটা পরিবার হন্যে হয়ে চাইছে সন্তানকে। আর তৃণমূল? নিখোঁজকে খুঁজে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থী করে। সমবেদনার পশরা সাজিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। রেল দুর্ঘটনায় নিহত, আহত পরিবারকে ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ডেকে এনেছিলেন চার দিনের মাথায়। পরীক্ষার কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সম্মাননার মতো সরকারি খরচে সমবেদনার ইভেন্ট সাজিয়ে ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। 
দলের ডিএনএ ম্যাচ করে রেল দুর্ঘটনায় নিখোঁজ যুবকের মাকে কার্যত তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গ্রামের ভোটে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে শাসকদল। আপনি কি এবার ভোটের প্রার্থী?
দুর্ঘটনার ১৭ দিন পার হওয়ার পর বাড়ির বড় ছেলের দেখা না পাওয়া মা পার্বতী হেমব্রম প্রশ্ন শুনে মাথা নামালেন। অস্ফূট স্বরে তাঁর জবাব ছিল, ‘‘এমনিতেই ছেলেটার এই অবস্থা। আমি আর পারছি না।’’ এরাজ্যে অনুদানের রাজনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। নিজে মুখেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, জন্ম থেকে মৃত্যু- সব কাজেই রাজ্য সরকার সাহায্য করে। তারপরেও ভোট এড়াতে লুটের আশ্রয় নিতে হয় শাসকদলকে! আটকাতে হয় বিরোধীদের মনোনয়ন। জমা পড়া মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চলে হুমকি, অত্যাচার। কিন্তু নির্মমতার সব ধাপ পার করে দিয়েছে শাসকদল। দুর্ঘটনায় নিখোঁজ সন্তানের মাকে ভোটে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সহানুভূতির ভোট করতে নেমেছে তৃণমূল। মহিলাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, সন্তানকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করা হবে। তবে তা শর্তাধীন। সেই শর্ত মেনে চোখের জল নিয়ে পার্বতী হেমব্রমকে যেতে হয়েছে ব্লক অফিসে। তুলিয়ে আনা হয়েছে মনোনয়ন পত্র। স্বাক্ষর করিয়ে তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোটের মাঠে। ‘‘যার ছেলের খোঁজ নেই, তাঁকে কেউ ভোটে দাঁড় করায়? ও কী করে ভোট চাইতে আসবে। ওর কী সেই মনের অবস্থা আছে!’’ প্রশ্ন করছেন আদিবাসী পাড়ার গরিব মানুষই। নির্মম তৃণমূল চায় ভোট। দখল। 
আপনি কী ভোটের প্রচার করতে পারবেন? চোখে জল নেমে আসে মায়ের। ‘‘ছেলেটারই খোঁজ চাইছি। মৃত হোক, জীবিতই থাকুক। তারই খোঁজ চাইছি।’’ বলছেন মা।  
পরিবার চাইছে, ভালো হোক, মন্দ হোক- ছেলেটার যেন একটা খোঁজ আসে। তৃণমূল চাইছে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভোটের সুবিধা। এমন নয় যে আদিবাসী পাড়ার ওই বুথে তৃণমূলের প্রার্থী নেই। একজনকে দাঁড় করিয়েও শাসকদলের পাল্টা গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে প্রার্থী হতে হয়েছে মহিলাকে। 
হুগলীর হরিপাল ব্লকের ওলিপুর কাশীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পানিশেওলা গ্রামের আদিবাসী পাড়া থেকে কাজের জন্য ভিনরাজ্যে যেতে হয়েছিল চার আদিবাসী যুবককে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের এস ১ কামরার ‘আরএসি’ টিকিট নিয়ে সওয়ার হয়েছিলেন চারজন। দুর্ঘটনার পর আহত তিন যুবক হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এখনও খোঁজ নেই বছর কুড়ির গোপাল হেমব্রমের। 
সন্তানের দেহ খোঁজার জন্য মা রক্ত দিয়ে বসে আছে। অশনাক্ত দেহের সঙ্গে সেই রক্তের ডিএনএ মিলিয়ে রেল প্রশাসন থেকে এখনও খবর আসেনি। সেই নিখোঁজ সন্তানের মার কাছে সন্তানকে খুঁজে আনার পৈশাচিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল।
তফসিলি ও আদিবাসী নিবিড় গ্রামে মানুষের কোনো কাজ নেই। গত মার্চে শেষবার খেতমজুরদের গ্রাম মাঠ থেকে আলু তোলার কাজ পেয়েছিল। ওই শেষ। তারপর থেকে আড়াই মাস কেটে গেছে গ্রামের খেতমজুরদের কোনো কাজ নেই। সিপিআই(এম)’র হরিপাল এরিয়া কমিটির সম্পাদক জানান, ‘‘এখন যন্ত্রের আমদানি হওয়ার ফলে ধান কাটার সময়ও আগে যে এক দেড় মাস কাজ থাকত তা আর জোটে না। তফসিলি, আদিবাসী এলাকার গরিব পাড়াগুলো এখন কমবয়সি কোনো ছেলে পাবেন না। সব বাইরে চলে যাচ্ছে। 
১০০দিনের কাজ নেই। কাজ করেও মজুরি নেই। ‘‘১৩টা কিষেন খেটেছিলাম ১০০দিনের কাজে। কই, সেই পয়সা তো সব গায়েব হয়ে গেল।’’ বলছিলেন রেল দুর্ঘটনায় জখম হয়ে গ্রামে ফিরে আসা তাপস কিস্কু। রেগায় কাজ নেই। এরাজ্যে আর কোনো কাজের সংস্থান না করতে পেরেই চার যুবক উঠে পড়েছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। চেন্নাই হয়ে ওঁদের গন্তব্য ছিল কেরালা। সেখানে ফার্নিচারের কাজ করে পরিবারের কাছে টাকা পাঠানো। ‘‘কাজ থাকলে কি আর ঘরের ছেলেরা বাইরে যেত? এখানে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ সপ্তাহে তিন দিন হলে চারদিন বন্ধ থাকে। তারও সাতদিন পর টাকা পাওয়া যায়।’’ বলছিলেন দুর্ঘটনার পর ঘরে ফেরা যুবকের দিদি। 
রাজ্যে এখন পঞ্চায়েত ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। ভোটের দিকে নজর নেই গ্রামের যুবকদের। এখন ট্রেন দেখলেই আতঙ্ক তাড়া করছে। ঘুমের মধ্যে ফিরে আসছে দুর্ঘটনার ভয়াল ছবি। তবু ওরা জানে, একদিন আবার গ্রাম ছাড়তেই হবে।  

ক্যাপশান- নিখোঁজ সন্তানের খোঁজে মা পার্বতী হেমব্রম।
 

Comments :0

Login to leave a comment