Post Editorial

দেশ, করোনা এবং আমাদের পরিযায়ী শ্রমিক

উত্তর সম্পাদকীয়​

গার্গী চ্যাটার্জি


‘পথের ধুলোয় জীবন খুঁজে ফেরে’—এই কথাটি ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের বেদনাদায়ক বাস্তবতার চেয়ে আর কোথাও এতটা প্রাসঙ্গিক নয়। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরে দাঁড়িয়ে যখন আমরা ‘নতুন ভারত’-এর স্বপ্ন দেখি, তখনও দেশের অন্তত ১৪–১৫ কোটি মানুষ রুটিরুজির সন্ধানে ভিন রাজ্যে—কখনও ভিন দেশে—অধিকারহীন, নিরাপত্তাহীন, পরিচয়হীন অবস্থায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
১৯৭৯ সালে ‘Inter-State Migrant Workmen (Regulation of Employment and Conditions of Service) Act’পাশ হয়েছিল, উদ্দেশ্য ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা, অধিকার ও মজুরি নিশ্চিত করা। অথচ, বাস্তব পরিস্থিতি প্রমাণ করে দিয়েছে—এই আইন শুধুই ‘আবরণ’। এর প্রকৃত প্রয়োগ বা নজরদারি আজও অধরা।
২০২০ সালে করোনা-লকডাউন এই দগদগে ক্ষতকে জনসমক্ষে খুলে দেয়। পরিযায়ী শ্রমিক বলতে তখনও অনেকে বুঝতেন না, অথচ রেলপথ, হাইওয়ে, গ্রীষ্মের খরতাপে হাজার কিলোমিটার হাঁটতে থাকা মানুষেরা মনে করিয়ে দেয়—এই রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্ববৃহৎ অথচ সর্বাধিক অবহেলিত শক্তিই এরা।
কোভিড-১৯: পরিযায়ী শ্রমিক সঙ্কটের নগ্ন চিত্র
২০২০ সালের মার্চ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লকডাউনে দেশের বৃহত্তম শহরগুলিতে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মুহূর্তে কাজ হারালেন। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, কর্নাটকের নির্মাণক্ষেত্র, কলকারখানা, দোকানপাট, হোটেল— সব বন্ধ। কেউ গাড়ি পাবেন না, ট্রেন নেই, বাস নেই— অথচ পরিবারের কাছে ফিরতেই হবে। হাতে নগদ ফুরিয়েছে, রেশন নেই, মালিক দায়িত্ব নিল না। বাধ্য হয়ে হাজার হাজার মানুষ রওনা দিলেন পায়ে হেঁটে— দিল্লি থেকে বিহার, সুরাট থেকে বাংলার মালদহ, উত্তর প্রদেশ থেকে ওড়িশা!
আনুষ্ঠানিক তথ্য বলছে, সেবার ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেনে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। পথে দুর্ঘটনায়, ক্ষুধায়, লাঠিচার্জে মারা গেছেন অন্তত ৩০০-র বেশি মানুষ। রেললাইন ধরে হাঁটতে গিয়ে ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর ট্রেন চলে গেছে, শিশুশ্রমিক জামলোমাকদমের মতো কিশোরীর নিথর দেহ দেশের বিবেককে বিদ্ধ করেছিল।
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বনাম প্রশাসনিক নীরবতা
লকডাউনের প্রথম ধাক্কা সামলাতে গিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন, বিশেষত সিআইটিইউ’র মতো সংগঠন আন্দোলন গড়ে তোলে। রাজ্য প্রশাসনের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারা পরিযায়ী শ্রমিকদের স্পেশাল ট্রেনে নিজঘরে ফিরে আসাকে ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলে কটাক্ষ করে বিশেষ ট্রেনগুলি সম্পর্কে জনমানসে ঘৃণা ও কুসংস্কার ছড়ানো হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন— শ্রমিকদের তালিকা হবে, ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ হবে, ক্ষতিপূরণ, পোর্টাল হবে। বাস্তবে কতটা হলো? 
বাস্তবতা এই যে, কেন্দ্রের উদাসীনতা আর রাজ্যের দ্বিচারিতা যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়, তখন সর্বভারতীয় সিআইটিইউ নেতৃত্ব ও রাজ্যস্তরের সিআইটিইউ কমিটিগুলো এগিয়ে আসে মানুষের পাশে।
কোভিড-১৯ এর সেই বিপর্যয়ের দিনে, যখন দেশ জুড়ে লকডাউনে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক রোজগার হারিয়ে ভিন রাজ্যে আটকে পড়েছিলেন, তখন রাজ্য সিআইটিইউ একা নয়— সারা দেশের নানা রাজ্যের সিআইটিইউ রাজ্য কমিটির সহযোগিতায় ও সর্বভারতীয় নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বাংলার ও অন্যান্য রাজ্যের শ্রমিকদের কাছে খাদ্য, ওষুধ, সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তাদের ঘরে ফেরানোর জন্য ট্রেন-বাসের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল, বহু ক্ষেত্রেই নিজের খরচে শ্রমিকদের ট্রেন-বাস ভাড়া দিয়ে ফেরানোর ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল।
এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সিআইটিইউ শুধু ত্রাণ ও ফিরিয়ে আনার মধ্যেই থেমে থাকেনি। তারা গ্রামের পর গ্রামে ফিরে আসা শ্রমিকদের খুঁজে বের করে তাঁদের সংগঠিত করেছে, ইউনিয়নের ছাতার তলায় এনেছে, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে লাগাতার চাপ সৃষ্টি করেছে যাতে নথিভুক্তিকরণ হয়।
এই সংগঠিত চাপের ফলেই আজ রাজ্য সরকার নামমাত্র হলেও কিছু ক্ষতিপূরণ ও পোর্টালভিত্তিক নথিভুক্তি শুরু করতে বাধ্য হয়েছে— যা মুখে ‘গরিবের পাশে থাকার সরকার’ বহুদিনেও করেনি, তা করাতে হয়েছে আন্দোলনের চাপে।
তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে নাগরিক সংগঠনগুলো বারবার আবেদন করলেও পশ্চিমবঙ্গের শ্রমদপ্তর এই তথ্য আজও প্রকাশ করেনি। সুপ্রিম কোর্টও ২০২০–২১ সালে বারবার রাজ্যগুলিকে হলফনামা দিতে বলেছিল— পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষায় কী ব্যবস্থা হয়েছে? কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যের মতো বাংলাও কার্যত ব্যর্থ।
‘ই-শ্রম’ পোর্টাল ও অদৃশ্য সুবিধা
২০২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ই-শ্রম’ পোর্টাল চালু করে। বলা হয়েছিল— অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পরিচয় ও সুরক্ষা দিতে এই নথিভুক্তি জরুরি। পশ্চিমবঙ্গে লক্ষাধিক মানুষ এই পোর্টালে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— পরিচয়পত্র ছাড়া আর কী সুবিধা তাঁরা পেয়েছেন? স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে পৌঁছেছে তাঁদের কাছে? মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা, শিশুশিক্ষা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা— এগুলো কি শুধুই কাগজে?
‘ই-শ্রম’ পোর্টাল চালু হওয়ার পরপরই বিপুল প্রচার— টিভি, রেডিও, ব্যানার-পোস্টার— সব জায়গায় বলা হয়েছিল, ‘ই-শ্রম কার্ড থাকলে শ্রমিকদের সরকারি প্রকল্পের সরাসরি সুবিধা মিলবে।’ শ্রমিকরা অনেকেই জানেন না, এই কার্ড দিয়ে কীভাবে সরকারি প্রকল্পে যুক্ত হতে হবে। ইউনিয়ন বা সচেতন নাগরিকেরা জানালে জানে, নাহলে তথ্যই নেই। কোনো ফলো-আপ কাউন্সেলিং, হেল্প ডেস্ক, ব্লক বা পৌরসভায় আলাদা শাখা গড়ে তোলার কোনও চেষ্টা নেই। আবার, পোর্টাল কেন্দ্র চালালেও বাস্তবে রাজ্যের শ্রম দপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনকে সমন্বয় করতে হয়। কিন্তু রাজ্যস্তরে নেই কোনও পূর্ণাঙ্গ সমন্বয়। কোথায় কত শ্রমিক নাম লিখিয়েছে, কে কোন প্রকল্পের যোগ্য— তা যাচাই করার সিস্টেম নেই। 
গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বন্দ্ব নাটক— কোনও কোনও রাজ্যে বিজেপি শাসন, কোনও রাজ্যে বিরোধী দল— এই দ্বন্দ্বে কেন্দ্রীয় স্কিমগুলোর বাস্তব রূপায়ণ প্রায় অকার্যকর হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে—‘ই-শ্রম’-এর মাধ্যমে প্রকৃত সাহায্য পৌঁছানোর রাস্তা এখনও তৈরি হয়নি।
ভাষা, পরিচয় ও রাজনৈতিক শোষণ
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ‘বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিক’ ইস্যুটি আচমকা নয়, দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা, অবহেলা আর রাজনৈতিক অজুহাতের ধারাবাহিকতারই পরিণতি। অভিযোগ উঠেছে- এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে একটি ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’ জারি হয়— তাতে সরাসরি না বলা হলেও কার্যত নির্দেশ, “বাংলাভাষী শ্রমিকদের প্রতি অতিরিক্ত নজরদারি রাখা হোক, তারা ‘অনুপ্রবেশকারী’ হতে পারে”।
এই একটি নির্দেশ দেশজুড়ে বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ‘বাংলা বলা মানেই বাংলাদেশি, আর বাংলাদেশি মানেই সন্দেহভাজন’— এই বহু পুরনো অপবাদকে ফের রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা ।
এই সূত্রে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘বাংলা বলা’-কে ‘সন্দেহের চোখে’ দেখার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। বিজেপি শাসিত রাজ্যে এই বিজ্ঞপ্তিকে হাতিয়ার করে বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’, ‘রোহিঙ্গা’ অপবাদে আটক, নির্যাতন, দেশছাড়া করার অভিযোগ ওঠে। এমনকি সীমান্তে বিএসএফ দিয়ে ‘পুশব্যাক’ পর্যন্ত!
বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF) সীমান্তে নজরদারি রাখে দেশের নিরাপত্তার জন্য—  কিন্তু নিজ দেশের নাগরিকদেরকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার নজির আন্তর্জাতিক আইনে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
সীমান্তের গ্রামে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়া বহু শ্রমিককে সীমান্ত চৌকিতে বিএসএফ আটক করছে, ‘বাংলাদেশি’ অপবাদে গোপনে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দিচ্ছে— যারা ফিরছে, তারা নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছে।
আরও ভয়ঙ্কর অভিযোগ আসছে— রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাসের পর মাস আগে এই নোটিফিকেশন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কোনও প্রতিবাদ করেননি। রাজ্যের শাসক দলের এই নীরবতা কি কেন্দ্রের সঙ্গে কোনও গোপন সমঝোতা? না কি ‘বাংলা ও বাঙালির অধিকার’ শুধুই রাজনৈতিক স্লোগান? 
ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব এখনও ঠিকানা দিয়ে নির্ধারিত হয়। অথচ আজকের অর্থনীতিতে মানুষ কাজের খোঁজে অন্তঃরাজ্য বা আন্তঃরাষ্ট্র গমন করতেই বাধ্য হয়। সস্তায় থাকার জায়গা নেই, সরকারি বাসগৃহ নেই, ফলে বস্তিতে থাকতে হয়। পুলিশি হয়রানি, অবৈধতার অপবাদ, ঠিকাদারের শোষণ— সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তা।
২০২০-তে বেঙ্গালুরুতে প্রায় ২৫ লক্ষ শ্রমিকের কোনও নথি ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে শ্রমিকরা রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, দিল্লি, হরিয়ানা— সব জায়গায় কাজ করতে যান, তাঁদের জন্য কোনও ‘সেফপাসেজ’ নেই। পরিচয়পত্র নেই, ‘মাইগ্রান্টওয়ার্কারহোস্টেল’ নেই। ব্যতিক্রম একমাত্র কেরল ।
কেন কেরল ব্যতিক্রম ?
কেরল সরকার প্রথম থেকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘Guest Workers’বা ‘অতিথি শ্রমিক’ নামে চিহ্নিত করে— ভাষার ভিত্তিতে নয়। এই ধারণা প্রচলিত হয় ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ— যখন কেরলে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে লাখ লাখ শ্রমিক ঢুকতে শুরু করেন, মূলত নির্মাণ, হোটেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, চা-কারখানা, টেক্সটাইল, হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে।
যাতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সংঘাত না হয়, আর শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যূনতম অধিকার সুনিশ্চিত করা যায়— সে জন্য সরকারই এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘অতিথি শ্রমিক’ আখ্যা দেয়।
কেরল একমাত্র রাজ্য যেখানে সরকার নিজেই- ‘Aawaz Insurance’ (স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা বিমা), 
‘ApnaGhar’ (কম খরচের সরকারি হস্টেল), ‘Skill Registry’ (পরিযায়ী শ্রমিকদের দক্ষতা তালিকাভুক্তিকরণ), ‘Ayyankali Urban Employment Guarantee Scheme’এর মতো প্রকল্প চালু করে। 
অন্য রাজ্যগুলোতে এই ধরনের সুসংগঠিত স্কিম প্রায় নেই বা কাগজে থাকে—  কিন্তু কেরলের ক্ষেত্রে তা বাস্তবিকই চালু প্রকল্প।
কেরলে বাংলাভাষী শ্রমিক, হিন্দি বা ওড়িয়া ভাষাভাষী শ্রমিকদের আলাদা করে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘বিদেশি’ বলা হয় না। কেরলের প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সুন্দর সহযোগিতা আছে — সিপিআই (এম) ও সিআইটিইউ এখানকার প্রধান শক্তি— তারা শুরু থেকেই শ্রমিকদের স্থানীয় সামাজিক জীবনে যুক্ত করার চেষ্টা করেছে।
কেরলে লাখ লাখ বাংলাভাষী শ্রমিক আছেন (মূলত মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া, উত্তর দিনাজপুর থেকে)। তাদের সন্তানদের জন্য মালায়ালম ভাষা শেখানোর পাশাপাশি বাংলা-মালায়ালম-ইংরেজি মিশ্র মিডিয়াম স্কুল চালানোর উদাহরণও আছে। 
কোথাও কোথাও বাঙালি সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েত বা সমিতি গড়ে উঠেছে— স্থানীয় থানাও তাদের রেজিস্টার করে।
কেরলে বিজেপি রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় নেই, এবং এখানে সাম্প্রদায়িক বা ভাষাভিত্তিক ভোট রাজনীতি প্রধান হাতিয়ার নয়— সিপিএম, কংগ্রেস ও বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে বাংলাভাষী বলেই কাউকে ‘বাংলাদেশি’ বলা বা আটকানোর প্রবণতা মূলধারার প্রশাসনে নেই। ফলে কেরল ব্যতিক্রম
২০২৫ সালের এই বিতর্কের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো— ওডিশা-র মতো একদম পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের উপরে নতুন করে চাপানো ‘সন্দেহ’ আর প্রশাসনিক হয়রানি।
কেন ওডিশা গুরুত্বপূর্ণ?
• পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ঝাড়গ্রাম, নদীয়া, পূর্ব মেদিনীপুর— এই সব জেলার হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিবছর গোপালপুর, বালেশ্বর, পারাদ্বীপ বন্দর, পুরী, ভুবনেশ্বর সহ ওডিশার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যান।
• সাগর ও নদী কেন্দ্রিক মাছ ধরার ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, ছোট-বড় নির্মাণ সাইট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, গৃহস্থালির কাজে বাঙালি শ্রমিকের চাহিদা প্রচুর।
• বহু শ্রমিক মৌসুমি— পুজোর আগে বা শীতে আবার ফিরে আসেন, ফলে এদের স্থায়ী ঠিকানা ওডিশায় নেই— এই ফাঁকেই সন্দেহ আর শোষণের সুযোগ তৈরি হয়।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে ওডিশার একাধিক জেলা প্রশাসন ও থানার স্তরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ একসাথে অভিযান শুরু করে— বলা হয়, ‘বাংলাভাষী শ্রমিকদের নথি যাচাই করা হবে, বৈধতা প্রমাণ করতে হবে’।
অভিযোগ- ঠিকাদারদের বলা হয়, বাংলাভাষী হলে পুলিশের কাছে তালিকা দিতে হবে। অনেক জায়গায় রাতের বেলা শ্রমিকদের হস্টেলে তল্লাশি হয়। একাধিক ক্ষেত্রে ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’ অপবাদে শ্রমিক আটক, গ্রাম্য নেতাদের হাতে বেদম মারধর ও পুলিশি হেপাজতে রাখার ঘটনা ঘটে। সীমান্তে বিএসএফ’র মাধ্যমে ‘পুশব্যাক’-এর ভয় দেখিয়ে চুপ করানো হয় — যাতে শ্রমিকেরা থানায় অভিযোগ না জানায়।
রাজ্যের সিআইটিইউ ও স্থানীয় বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি ওডিশার শ্রমিক সংগঠনগুলির সাথে যোগাযোগ করে ত্রাণ, আইনি লড়াই ও গণআন্দোলন গড়ে তোলে। মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামসীমান্তে গ্রামে গ্রামে সচেতনতা সভা হয়— শ্রমিকরা বুঝতে শিখেছেন ‘ভাষা’ কোনও অপরাধ নয়, আর নিজ দেশের নাগরিক হিসাবে কাজ করা অধিকার।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানতেন,ওডিশা সীমান্তে কী হচ্ছে — কারণ, ইতিমধ্যে রাজ্যের শ্রম দপ্তর ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে একাধিক স্মারকলিপি জমা পড়েছে। তবু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্লোগান থাকলেও এই সীমান্তে বাংলাভাষী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভূমিকা
শুধু কাগজে নয়, শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানোর কাজ একমাত্র বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলিই ধারাবাহিকভাবে করেছে। সিআইটিইউ এদের মধ্যে অন্যতম। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি, স্বাস্থ্যশিবির, নথিভুক্তি, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই—সব ক্ষেত্রেই সক্রিয় থেকেছে বামপন্থীরা।
যখন মুখ্যমন্ত্রী ‘করোনা এক্সপ্রেস’ বলেন, তখন তার প্রতিবাদও সিআইটিইউ করেছে। আজও করছে। ২০২৫ সালের ঘটনায়ও বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন, সিপিআই (এম) সহ বামদল ও নাগরিক সমাজ সরব, প্রশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছে, আইনি লড়াই লড়ছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কী করণীয়?
১. সর্বভারতীয়পরিচয়পত্র: শ্রমিকরা যেখানেই থাকুন, সেখানেই যেন স্বাস্থ্য, রেশন, শিশুশিক্ষা, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা পান।
২. বাসস্থান ও হস্টেল: প্রতিটি শহরে শ্রমিক হস্টেল তৈরি বাধ্যতামূলক করা হোক।
৩. ন্যূনতম মজুরি ও নথিভুক্তি: ১৯৭৯ সালের পরিযায়ী আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ ও কঠোর নজরদারি। ঠিকাদার, নিয়োগকর্তা—সবার জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
৪. পোর্টাল নয়, কার্যকর নেটওয়ার্ক: নথিভুক্তি মানেই একটি কাগজ নয়, প্রকৃত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা: ভাষা, জাতি ও আঞ্চলিকতার নামে বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করতে জাতীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নয়, সরাসরি প্রতিরোধ করতে হবে।
পরিশেষে একথা বলতেই হবে— একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিচয়, ভাষা বা বাসস্থান দিয়ে নাগরিককে অবজ্ঞা করা যায় না। পরিযায়ী শ্রমিকরা শুধু ‘শ্রম’ নন, তাঁরা ভারতের অর্থনীতির অদৃশ্য স্তম্ভ। তাঁদের ঘামে সিমেন্ট, ইট, গাড়ি, রাস্তা, শহর দাঁড়ায়। অথচ তাঁদেরই পরিচয়হীন, সুরক্ষাহীন রেখে দেওয়া হয়। এই অবমাননার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে ।
কেন্দ্রের নিপীড়ন, রাজ্যের নীরবতা আর মেনে নেওয়া যায় না। বাংলার মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব— বিজেপি-তৃণমূলের নীতিহীন লুকোচুরিকে উন্মোচিত গরিব, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে উন্মোচিত করা। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন, বামদল ও নাগরিক সমাজের নেতৃত্বে এক নতুন লড়াই গড়ে তুলতে হবে— পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য, এই বাংলার জন্য, ভারতের জন্য।

 

Comments :0

Login to leave a comment