Editorial

নির্বোধ পদক্ষেপ

সম্পাদকীয় বিভাগ

কেন্দ্রীয় সরকার তথা মোদী-শাহর প্রতিনিধি হি‍‌সাবে যিনি জম্মু ও কাশ্মীর শাসন করছেন সেই লেফটেনেন্ট গভর্নর মনোজ সিনহা কাশ্মীরের অতীত ও বর্তমান বিষয়ক ২৫টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে এই বইগুলি কেনা-বেচা বা পড়া যাবে না। অবশ্য সেখানকার মানুষ কাশ্মীরের বাইরে গিয়ে বইগুলি কিনতে বা পড়তে পারবেন কিনা সেবিষয়ে কিছু জানা যায়নি। আরএসএস-বিজেপি’র পরামর্শদাতারা মনোজ সিনহাকে বুঝিয়েছেন উল্লিখিত বইগুলি পড়লে কাশ্মীরের যুব সমাজ বিভ্রান্ত হবে, সন্ত্রাসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হিংসায় লিপ্ত হবে। কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে জারিত অন্ধ হিন্দুত্ববাদীরা যা বুঝিয়েছে মনোজ সিনহাও তাই বুঝেছেন। অতএব কর্তার ইচ্ছায় কর্ম সাধনের জন্য ২৫টি বিখ্যাত বই নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বইগুলির লেখকরা কেউই মামুলি লেখক নন। দেশ-বিদেশে তাদের যথেষ্ট সুনাম ও পরিচিতি আছে। তাছাড়া শুধু কাশ্মীর নিয়ে তারা বই লেখেননি, ইতিহাস রাজনীতি, সমাজ নিয়ে তাঁদের আরও অনেক বই আছে।
নিষিদ্ধ ঘোষণায় এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে বইগুলির বক্তব্য, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আরএসএস-বিজেপি’র ঘোর আপত্তি আছে। এটাও ভাবার কারণ নেই যে বইগুলির বক্তব্যের  সঙ্গে আরএসএস পন্থী ছাড়া বাকি সব দল ও ব্যক্তিরা একমত। লেখকরা নানা তথ্য ও বাস্তবতাকে নিজেদের ভাবনা চিন্তা দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। অনেক অজানা তথ্য, অনালোচিত বিষয় যেমন বইগুলিতে আছে তেমনি ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে অনেক ভ্রান্তি, অনেক অযৌক্তিক ও অবাস্তব ভাষ্যকে খণ্ডন করা হয়েছে। বিশেষ করে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব মনগড়া ধ্যানধারণা নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলিই বেশি আক্রান্ত হয়েছে এই সব বইয়ের অন্তর্নিহিত ভাবপ্রবাহে। এক বগ্‌গা হিন্দুত্ববাদীরা যেহেতু কোনও সমালোচনা, বিরুদ্ধ মত সহ্য করতে পারে না তাই বইগুলি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বই নিষিদ্ধ করে যে বই পড়া বন্ধ করা যায় না, নিষিদ্ধ বইয়ের ভাষ্য-ভাবনা মনে পৌঁছানো আটকানো যায় না, ধর্মান্ধরা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও উপলব্ধি করতে পারেনি।
আসলে কর্তৃত্ববাদী, আধিপত্যবাদী মানসিকতার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ত শাসকরা এমনই হয়ে থাকে। ভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত করে তাদের নতজানু করে রাখা যায়। কাশ্মীরের মানুষের সাংবিধানিক বিশেষ অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, মত প্রকাশের বিরোধিতার— সমালোচনার অধিকার, কেড়ে নিয়ে ভাবছে তাদের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলা যাবে। কিন্তু প্রথমে পাঁচ পরে ছ’বছরের ইতিহাস বলছে কাশ্মীরে মোদী-শাহদের কোনও লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়নি। সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্যাতন বেড়েছে। সর্বদা ভয়ে ও আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে শাসককে। তাই বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফেরত দেয়নি। শাসনের চাবুক রেখে দিয়েছে নিজেদের হাতে। তারা বুঝে গেছে ধর্মান্ধতা ও হিন্দুত্বের আফিম কাশ্মীরে গেলানো যাচ্ছে না। তাদের চিন্তার, জ্ঞানের, চর্চার অধিকারও কেড়ে নিয়ে নির্বোধে পরিণত করার প্রয়াস। বই নিষিদ্ধ এমন নির্বোধ ভাবনা থেকেই। কাশ্মীরের মানুষ কোন বই পড়বে আর কোন বই পড়বে না সেটা ঠিক করে দেবেন মোদী-শাহরা।

Comments :0

Login to leave a comment