ময়ূখ বিশ্বাস
ট্রাম্পের তারিফ নিতে মোদী সরকার ‘নমস্তে ট্রাম্প' থেকে ‘হাউডি মোদী’ কিছুই বাকি রাখেনি। কিছুদিন আগেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী ট্রাম্পের জন্মদিন পালন করত, এমনকি তার জয়ের জন্য যাগযজ্ঞও করেছিল। এখন ভাঁড়ে মা ভবানী করে ট্রাম্প ভারতের ওপর মোট ৫০ শতাংশ 'ট্যারিফ' বা শুল্ক আরোপ করেছে, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কেনার 'অপরাধে' এই রপ্তানি শুল্ক প্রযোজ্য হলে চামড়া, পোশাক, তথ্য প্রযুক্তি ও কৃষি ক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং লাখো মানুষের চাকরি যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আমেরিকার এই দাদাগিরির পরেও সব বিষয়ে ভাষণ দেওয়া ‘৫৬ ইঞ্চি বিশ্বগুরু’ চুপ। আসলে আরএসএস ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধী নীতিকে সমর্থন করেছিল, কারণ তারা ট্রাম্পের বিভেদমূলক পদক্ষেপগুলোকে নিজেদের সাম্প্রদায়িক অ্যা জেন্ডার সঙ্গে মিলে যেতে দেখেছিল— ভেবেছিল, ট্রাম্প ওদের 'মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইটি।' তাই এখন মোদী পড়েছেন মহা ফ্যাসাদে। এর ফাঁকে ঠান্ডা সম্পর্ক থাকলেও চীন তাদের অবস্থান বলে দিয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত জু ফেইহং নয়াদিল্লিকে সমর্থন করে X-হ্যান্ডেলে লিখেছেন, "গুন্ডামিকে এক ইঞ্চি ছাড় দিন, সে এক মাইল এগিয়ে যাবে।" এ ক্ষেত্রে চীন ও ব্রাজিলের আলোচনার অংশ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, কিভাবে মার্কিনীরা রাষ্ট্রপুঞ্জ-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মকে লঙ্ঘন করে অন্যান্য দেশকে দমন করার জন্য শুল্ককে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। এটা গোটা পৃথিবীকে করে তুলছে অস্থিতিশীল ও বিপজ্জনক।
দুনিয়া দ্রুত বদলাচ্ছে
দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষ অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল আবার বামপন্থার পথে হাঁটছে। ট্রাম্প-মোদীর মিত্র ফ্যাসিস্ত বলসোনারো হেরে গেছেন, আর শ্রমিক নেতা লুলা দা’ সিলভা জনআন্দোলনের জোরে ফের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। লুলা এখন মার্কিনিদের সমালোচনা করে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছেন। এদিকে, ব্রিকস ব্যাঙ্কের প্রধান হয়েছেন ব্রাজিলেরই সাবেক বামপন্থী প্রেসিডেন্ট দিলমা রোসেফ। এই ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে পশ্চিমী প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের বিকল্প হিসাবে। এসব দেখে মার্কিন ঘেঁষা পশ্চিমীদের ঘুমের ওষুধ সেবন স্বাভাবিক।
১৯৯০ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার এক বছর আগে, মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জেমস বেকার রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছিলেন— ন্যাটো পূর্ব দিকে এক ইঞ্চিও বাড়বে না, শর্ত ছিল জার্মানি একত্রীকরণে রাশিয়ার সম্মতি। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। আজ ন্যাটো প্রায় রাশিয়ার সীমান্তে ইউক্রেন পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, যা বর্তমান সংঘাতের মূল কারণ। ন্যাটো তৈরি হয়েছিল সোভিয়েতকে ঠেকানোর জন্য, কিন্তু সোভিয়েত বিলুপ্তির পরও সংগঠনটি ইউরোপ ছাড়িয়ে ইউক্রেন, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় বোমা মারছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রশ্ন: "আমরা কি কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছি? বরং আমেরিকার অস্ত্রই আমাদের দোরগোড়ায়। নিজেদের নিরাপত্তা চাওয়া কি অপরাধ?"
পাঁচশো বছর ধরে আফ্রিকার রক্ত-ঘাম শুষে খেয়েছে পর্তুগিজ, ফরাসি, ব্রিটিশ, বেলজিয়ামের মতো পশ্চিমী শক্তিগুলো। কিন্তু এবার পালা বদলের সময়! মালি, নাইজার, বুরকিনা ফাসোর মতো দেশগুলো পুরানো দখলদারদের তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। শান্তি স্থাপনের নামে ইউরোপ-মার্কিনীরা কীভাবে সোনা-ইউরেনিয়াম লুটেছে, তার হিসাব চাইছে আফ্রিকা। ফ্রান্সের দূতাবাস পর্যন্ত গুটিয়ে নিচ্ছে ওই দেশগুলো থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষী শাসনের অবসান হলেও, ওদেশে বেশিরভাগ জমির মালিক শ্বেতাঙ্গরা। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় ভূমি সংস্কারে দাবি বাড়ছে। পাশাপাশি, পশ্চিমের হুমকিকে উপেক্ষা করে তারা দাঁড়িয়েছে ফিলিস্তিনের পাশে, ইজরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন আদালতে লড়াইয়ে নেমেছে নির্ভীকচিত্তে। এই সাহস দেখে ট্রাম্পদের চোখ লাল! কিন্তু আফ্রিকা আর একা নয় — ব্রিকস মানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সাথি হয়েছে আরও ২৮টি দেশ। এখন ব্রিকস তার শক্তিশালী হাতিয়ার।
পশ্চিমী শক্তিগুলির দাদাগিরির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে জমা হয়ে আসছে। আমেরিকা ও তার মিত্ররা নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়, কথা না শুনলেই নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক হামলা চালায়। লিবিয়ার মতো উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে— গদ্দাফি ডলারের দাপট মানতে অস্বীকার করায় পুরো দেশটাই ধ্বংস করে দিয়েছে পশ্চিমীরা। কিউবার উপর ছয় দশক ধরে অবরোধ, ইরানের তেল বিক্রিতে বাধা, রাশিয়ার তেল কেনায় ভারতকে হুমকি— এসবই পশ্চিমী শক্তির একচেটিয়া আধিপত্যের প্রমাণ। সেক্ষেত্রে বিকল্প 'ব্রিকস' শুধু অর্থনৈতিক জোট নয়, বিশ্বে প্রকৃত সমতা প্রতিষ্ঠার মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে ।
আর এই ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো আমাদের পার্টি সিপিআই(এম)’র সূত্রায়নের পরিপ্রেক্ষিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুনিয়ার শ্রম ও পুঁজি, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। সেই আলোকে বহুমেরু বিশ্ব গড়ার এক সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। অবশেষে সোভিয়েত পতনের পর কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে নয়া উদারবাদের পোশাকি পথ 'মনরো ডকট্রিন' এবং হিমালয়ের দু’ধারে এশিয়ার দুই সুপ্রাচীন সভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ।
হাতি ও ড্রাগন
ভারত এবং চীন- দুটো দেশই ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা। বিপুল জনসংখ্যার এই দুই বিশাল দেশ। এদের মধ্যে ৩৮০০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। গোটা দুনিয়া সূদুর অতীত থেকে কৃতজ্ঞ এদের কাছে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ নাগাদ মধ্য এশিয়ার উপজাতিদের মাধ্যমে চীন প্রথম পরোক্ষভাবে ভারতের সাথে পরিচিত হয় এবং পরে হান সাম্রাজ্যের সময়, ২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। ভারতকে শেন্দু (সিন্ধু থেকে) এবং তিয়ানঝু (স্বর্গীয় বাঁশের বন) বলা হতো চীনে। ভারত বিশ্বকে শূন্য সংখ্যা, দশমিক পদ্ধতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও ক্যালকুলাস উপহার দিয়েছে, যেখানে ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধায়ন পাই (π)-এর মান নির্ণয় করেছিলেন । অন্যদিকে, চীন "সেরিকা" (রেশমের দেশ) নামে পরিচিত ছিল এবং কাগজ, বারুদ, কম্পাস, মুদ্রণ প্রযুক্তি, আবাকাস ও বাইনোমিয়াল তত্ত্বের মতো যুগান্তকারী উদ্ভাবনের জন্ম দিয়েছে। প্লিনির মতে, রোমে চীনের লোহা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হতো। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে চীনের উৎপাদন প্রযুক্তি পশ্চিমের চেয়ে এগিয়ে ছিল। মার্কোপোলোরা চীনের কাগজের মুদ্রার মতো উন্নত অর্থব্যবস্থা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।
বৌদ্ধধর্মের প্রসারে চীন ও ভারতের সম্পর্ক গভীর ছিল। অজন্তা ও ডুনহুয়াংয়ের শিল্পকর্মে দুই সংস্কৃতির মিল দেখা যায়। অষ্টম শতকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গৌতম সিদ্ধার্থ চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার প্রধান হন। ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং-এর মতো চীনা পর্যটকরা বৌদ্ধগ্রন্থ নিয়ে ভারতে আসতেন, আবার অতীশ দীপঙ্করের মতো বাঙালি পণ্ডিতরা চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতেন। সঙ্গ যুগে (৯৬০–১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ), চীনকে বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র হিসাবে দেখা হতো। সে সময় ভারতে বৌদ্ধধর্মের রমরমা কমছে, তবু ভারতে থেকে অনেকেই চীনে যেতেন। চীন ছিল সেই পর্যটকদের কাছে মৈত্রেয় বুদ্ধ (ভবিষ্যৎ বুদ্ধ), মঞ্জুশ্রী (জ্ঞানের তরবারিধারী বোধিসত্ত্ব) এবং অমিতাভ বুদ্ধ (পবিত্র ভূমির ত্রাণকর্তা বুদ্ধ) এর দেশ। মঙ্গোল আক্রমণের পর চীনের সাথে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বেড়ে যায়, যার মাধ্যমে চোল ও রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য (অধুনা কর্নাটক) সমৃদ্ধি লাভ করে। চীনাদের প্রভাব দেখা যায় কালিকটের শাসক জামোরিনের নির্বাচন থেকে কোচিনের 'চীনা নেট'-এ। এমনকি ১৪৪০ সালে বাংলা-জৌনপুরের বিরোধ মেটাতেও চীনাদের ভূমিকা ছিল।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার শিকার হয়েছিল চীন ও ভারত। আফিম যুদ্ধে ইউরোপীয়রা মুনাফা লুটলেও, দুই দেশ প্রতিরোধও জানায়— থাইপিং বিদ্রোহ ও সিপাহী বিদ্রোহ তার প্রমাণ। পরবর্তীতে জাপান-বিরোধী যুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট নেতা ঝু দে নেহরুর সাহায্য চাইলে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু মেডিক্যা ল মিশন পাঠান। ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস সহ সেই দল চীনে স্মরণীয় হয়ে আছে— মাও জে দঙ তাঁকে মৈত্রীর প্রতীক বলেন। আর ১৯১৫ সালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি-র অনুবাদ করেছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চেন দু শিউ। তাই, সুদূর অতীত থেকে আধুনিক ইতিহাস অবধি তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই দুই প্রতিবেশী সভ্যতার মধ্যে দু’হাজার বছর ধরে সংঘর্ষহীন সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং আদান-প্রদান বজায় ছিল।
বান্দুং থেকে ব্রিকস
নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অত্যল্প কাল পরেই এলো ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ স্বীকৃতিদান আর বান্দুং-এর উষ্ণ সহযোগিতা। তার ফলস্বরূপ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চশীল নীতির প্রতি ব্যাপক সমর্থন। তারপর দেখা দিলো সংঘর্ষের কিছু ঝড়ো মেঘ। এই সীমান্ত সংঘর্ষের বীজ রোপিত ছিল ঔপনিবেশিক যুগ থেকে চলে আসা মুখ্যধারার বিকৃতির মধ্যে। আমাদের পার্টি সিপিআই(এম) প্রথম দিন থেকে আজ অবধি একটাই কথা বলে আসছে— আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশ তাদের বিবাদ মিটিয়ে ফেলুক এবং কয়েক হাজার বছরের ভারত ও চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক মজবুত হোক। তাই আমরা হয়ে গেলাম শাসকদের কাছে 'চীনের দালাল' আর 'চীনা বাদাম' বিক্রি করতে গিয়ে মার খেলো গরিব মানুষ! এদিকে ভারত সরকারের নানা রকম বিধিনিষেধ এড়িয়ে চীনা লগ্নিকারীরা এখন সিঙ্গাপুর হয়ে বা রিলায়েন্স গ্রুপের মতো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে ভারতে ব্যবসা করছেন।
ব্ল্যাক হোলের মতো একের পর এক শিল্প টেনে এনে প্রায় সব শিল্পখাতে চীন তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারতের রপ্তানির ৩০% চীনে যায়, এবং ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাত সত্ত্বেও দুই দেশের বাণিজ্য বেড়েছে— ২০২১ ও ২২ সালে যথাক্রমে ৪৩% ও ৮.৬%। ২০২০ সালে ভারত-চীনের ব্যবসা ছিল ৮৮ বিলিয়ন ডলার, যেখানে চীন ৪৬ বিলিয়ন ডলার এগিয়ে। চীনা কোম্পানিগুলো ভারতে স্মার্টফোন থেকে পরিকাঠামো প্রকল্পে সক্রিয়। এমনকি আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অব চায়নাকে অনুমোদন দিয়েছে। তবে রাজনৈতিক স্তরে বিদ্বেষের রাজনীতি চলছে: আরএসএস চীনা পণ্য বর্জনের ডাক দিলেও বিজেপি সরকার চীনের সাথে বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে। উত্তর প্রদেশের মীরাটে সুরঙ্গ নির্মাণ থেকে গুজরাটের সর্দার প্যাটেলের মূর্তির বরাত পাচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো।
বাস্তবতা হলো, ভারত ও চীনের স্বার্থে অনেক মিল— ব্রিকসের মাধ্যমে বিশ্বে প্রভাব বৃদ্ধি, রাশিয়াকে সমর্থন এবং পশ্চিমী সমালোচনা উপেক্ষা। এটা ভারতের কোনও সরকারই অস্বীকার করতে পারে না। এটাই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা । দেশের স্বার্থে-বিশ্বের স্বার্থে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে আরএসএস’র প্রয়োজন কমিউনিস্টদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো। এদিকে মোদী এইবার নিয়ে ১৪ বার চীন বেড়াতে গেলেন, আরএসএস নেতারাও চীন ঘুরে আসছে হরদম।
এসময় পশ্চিমী শক্তিগুলো ভারত ও চীনের বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে। তারা কোয়াড জোটের মাধ্যমে চীনকে ঘিরে রাখতে চায়, তাই ভারতকে পশ্চিমমুখী করতে চাপ দিচ্ছে। তাই ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলোর মধ্যেও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে মোদী সরকারের ভুমিকায়। এরাই ইজরায়েল থেকে পেগাসাস কেনে বিরোধীদের ওপর নজরদারি করার জন্যে। অস্ত্র কেনায় রুশ প্রভাব কমাতে মোদী সরকার গুরুত্ব বাড়াচ্ছে ইজরায়েলের ওপর। সাথে যুক্ত হচ্ছে 'হিন্দুত্ববাদী' আরএসএস ও ইজরায়েলের 'জায়নবাদী'দের উগ্র-মুসলমান বিরোধিতার 'কমন অ্যা জেন্ডা।' আবার পশ্চিমীদের চাপে 'চীনকে রোখা'র নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে 'কোয়াড' জোটে অংশ নেয়। আদপে এই জোট বৃহত্তর পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদেরই অংশ, যাদের লক্ষ্য তৃতীয় বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেইজন্যে দরকার বিশ্বের সবথেকে জনবহুল দেশ ভারতকে কবজা করা। সেক্ষেত্রে ওদের সেরা বাজি পশ্চিমী ঘনিষ্ঠ 'আরএসএস-বিজেপি' সরকার।
ঔপনিবেশিক যুগে ভারত মহাসাগর ছিল 'ব্রিটিশ লেক', কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াইয়ের মাঠে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই উত্তেজনা চরমে ওঠে। আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলকে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং এখানে তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী মোতায়েন করেছে। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশরা দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ মার্কিনিদের হাতে তুলে দেয়, মূলত সোভিয়েত প্রভাব ঠেকানোর জন্য। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ভারত ও চীনের উত্থান এই অঞ্চলের ভূ=রাজনীতিকে নতুন রূপ দিয়েছে। ভারতের জন্য পারস্য উপসাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী পর্যন্ত অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে চীনের জ্বালানি ও বাণিজ্য নিরাপত্তার জন্য এই সমুদ্রপথ অপরিহার্য। চীনের 'স্ট্রিং অব পার্লস' কৌশল ও 'ওবোর' প্রকল্প মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোয়াড জোট গঠন করতে চায়, পাশাপাশি ব্রিকসকে দুর্বল করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অঞ্চল এখন বিশ্ব রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
দরকার সহযোগিতা
চীনের ফুচিয়েন প্রদেশের ছুয়ানচৌ শহরে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের চিত্রকলায় ভারতীয় সভ্যতার ছাপ স্পষ্ট। এটি ভারত ও চীনের মধ্যে পশ্চিম ভারতের উপকূল থেকে মালাক্কা প্রণালী (সিঙ্গাপুর) হয়ে সমুদ্রপথে দীর্ঘকালের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। এখানে সিংহের ছবি দেখা যায়, যা দক্ষিণ ভারত বা চীনের স্থানীয় নয়। সিংহ ভারত ও চীন উভয় স্থানেই রাজকীয়তার প্রতীক হয়ে উঠেছিল এবং শ্রীলঙ্কার (সিংহল, বা সিংহ-লোক) ও সিঙ্গাপুরের (সিংহপুর, সিংহের শহর) মানুষেরা এই নাম গ্রহণ করেছিল। এটি দেখায় কিভাবে ধারণা, পণ্যের সাথে সাথে ভ্রমণ করে। এই ধারণা পরিবর্তনশীলও।
চীন-ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তিগুলো দ্রুত পালটে যাচ্ছে। এশিয়ার সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার দুই দেশকে তাই পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। সীমান্ত সংঘাত নিরসন হলে এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব কমবে, আর দুই প্রাচীন সভ্যতা বিশ্বকে ইউরো-কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সবসময় দুই দেশের সংলাপ ও ঐতিহাসিক বন্ধন মজবুত করার পক্ষে বলেছে। ঔপনিবেশিক 'বিভাজন ও শাসন' নীতি শুধু সংঘাত বাড়াবে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। ইউরোপ-আমেরিকায় সভ্যতার উত্থানের আগেই চীন-ভারত বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় করত। একবিংশ শতাব্দীতে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে এই সহযোগিতা অপরিহার্য—তা হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি মানুক বা না মানুক।
Comments :0