Reclaim Night

আজ রাতে ‘সম্ভ্রান্ত বিশ্রাম’-এর কোনও অবকাশ নেই

উত্তর সম্পাদকীয়​

চন্দন দাস

আমেরিকার কোনও কিছু ভালো লাগে না আমার— কেনেডির মৃত্যুই আমার ভালো লেগেছিল।’ একটি প্রবন্ধের অর্ধেক অন্তত এইভাবে বলা শুধু কবিদের পক্ষে সম্ভব। ‘সম্ভ্রান্ত বিশ্রাম’ ছেড়ে উঠে বসা নাগরিক মনের ঘৃণা এ’ভাবেও প্রকাশ করতে পারেন শক্তিশালীরা। 
শক্তি পারতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো যাঁরা কয়েকজন, তাঁদের পক্ষে সম্ভব। সম্ভব বলেই এই শহর জানে লাভপুরের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ির ছেলে জড়িয়ে ধরতে পারেন কিশোর কবিকে। কেন? প্রবল অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা জাগানো শব্দের জন্য। 
সেদিন সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা নাড়িয়ে দিয়েছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ১৯৪৩। গোড়ার দিক। সেদিনও ৪৬নং ধর্মতলা স্ট্রিট সেই ঘটনাস্থল। সেখানে গড়ে উঠেছিল প্রগতিশীল সাহিত্য, নাট্য চর্চার কেন্দ্র। সেদিন ‘ফ্যাসিস্ত-বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’-র বৈঠক ছিল। সেদিন বুধবার ছিল। সেখানে সুকান্ত ভট্টাচার্য পড়েছিলেন—‘‘এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি/নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি।/ আমার বসন্ত কাটে চালের লাইনে প্রতীক্ষায়,/আমার বিনিদ্র রাত্রে সতর্ক সাইরেন বেজে যায়।’’ তারপর? লাভপুরের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ির সন্তান, জেলেই রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাহিত্যের জগৎ আঁকড়ে ধরা মানুষটি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা পাঠ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ‘গণদেবতা’, ‘কালিন্দী’র স্রষ্টা। 
আমার শহর-গ্রাম সেই থেকে সুকান্তকে জড়িয়ে রেখেছে বুকে। এ’ বছর তাঁর শতবর্ষ। আবার এ’ বছর রাত-জাগা ‘অভয়া’র জন্য, ‘তামান্না’র জন্য— বিচারের দাবিতে। এ’ বছর রাত জাগা সব অবিচারের বিরুদ্ধে। সিবিআই ব্যর্থ যে তদন্তে, যে তদন্তে তারা কলকাতা পুলিশের সাজানো উত্তরপত্র টুকেছে, বিচারকে তারা দু’ পক্ষই প্রহসনে পরিণত করার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আসলে তো দুটি পক্ষ নয়। সিবিআই এবং কলকাতা পুলিশ, রাজ্যের শাসক আর কেন্দ্রের শোষক— একদিকে আছে কুয়াশার মতো বিভ্রান্তি ছড়িয়ে। কিন্তু সতর্ক সুকান্তর রাজ্য। আমার গ্রাম, শহর উত্তর চায়— তাহলে কিসের অধিকারে কেন্দ্রীয় সরকার চালানো বিজেপি ‘অভয়া’র বিচার চেয়ে নবান্ন-অভিযানের ডাক দেয়? আসলে রাজ্য, কেন্দ্রের যাবতীয় অবিচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা গণঅভ্যুত্থানকে তৃণমূলের সুবিধার জন্য বিজেপি’ই ভাঙতে নেমেছে। কোথায় ছিল এই বিভাজনকারীরা, এক বছর আগে? কিংবা গত একবছর তারা কীই বা করেছে? তাই এখন সব আক্রান্ত, ক্ষতবিক্ষত নিপীড়িতর হয়ে বিচারের দাবিতে জনসমাবেশে প্রতিবাদ-উদ্‌যাপনের সময়। 
আজাদি চাই— বিচারের নামে প্রহসনের সব চক্রান্ত থেকে। ভাষা, ধর্মের নামে যাবতীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে রাতের দখল তাই আজকের সংগ্রাম— তার অন্য কোনও ধর্ম নেই, ভাষা নেই—ঐক্য, বৃত্ত ভেঙে আরও বড় বৃত্ত গড়াই তার আজকের দায়িত্ব। 
বিশেষত এই সময়ে, যখন আমার শহর-গ্রাম চ্যালেঞ্জ করতে নেমেছে একটি ভাষ্যের—‘বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশি।’ কবিরাও শ্রমজীবী। আর তাই শ্রমের দরদ মাখা পংক্তি সাজিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ব্যাধ হতে পারেন যুদ্ধে। লিখতে পারেন,‘দেবতার সবই আছে—ছাতা নেই—নেই ওয়াটার প্রুফ/বৃষ্টির বিরুদ্ধে, ঝোড়ো হাওয়ায়/দেবতাদের দেশে ইংরেজি নেই—হিন্দী নেই/নেই ভাষা কোনো আর/ইংগিতে ইংগিতে বাংলাদেশের মতন কথা আছে তার/আছে যোগাযোগ—আছে কলংকের কাল—আছে চলাফেরা/দেবতাদের দেশে ইংরেজি নেই—হিন্দী নেই/ আছে লরির আওয়াজ, মুক্তি-যুদ্ধ/আছে গড়নির্ণয় দেওয়াল-ঘড়ি/আছে সবই যাকে তোমরা বলো ‘অ্যাসেট।’
মুক্তি-যুদ্ধ দেবতাদের দেশের বিষয়। সেই দেবতার নাম ধাম, বাড়ির ঠিকানা, মন্দির নাকি মসজিদ, নাকি গির্জা—সব অর্থহীন। তার বাস মানুষের হৃদয়ে। সে শুধু বাংলাভাষীর মতো ইঙ্গিতে ইঙ্গিতে যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে পারে। কিংবা ভালোবাসতে পারে। অথবা একইসঙ্গে দুটোই পারে নির্মাণের বেলায়। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন—‘ভালোবাসা অর্দ্ধেক স্থপতি।’ বাকিটা যুদ্ধের কাজ। দিন-রাত দখলে ভালোবাসা, যুদ্ধ পাশাপাশি। অভিন্ন। 
আজকের রাত — সেই ‘দেবতা’র রাত। কাল? মানুষের নির্মাণের দিন।
আমার শহর, গ্রাম যখন রাতের দখল নিতে ইশ্‌তেহার ছড়াচ্ছে মোবাইলে, কাগজে, মননে। তখন শক্তিরই পংক্তি হবে শাক্ত যৌবনের স্লোগান—‘এই বাংলাদেশে ওড়ে রক্তমাখা নিউজপেপার/ বসন্তের দিনে...।’ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে অবশ্যই নাগরিক সেই কবির রচনাশৈলী নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। জানি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর থাকেন না এই শহরে। আর আবৃত্তি করেন না। আর লেখেন না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ভালোবাসার একটি মরমী মানুষ হারিয়েছে শহর। হারিয়েছে বাংলা। দেশ? বাংলা ছাড়া দেশ নেই। ভূ-ভারতে বাংলা আছে স্পর্ধার সমনাম হয়ে।
এও জানি, এখন বসন্ত নয়। কিন্তু আমাদের ‘স্বাধীনতা মাসে’ অনেক সময়েই বসন্ত আসে। আগে এসেছে। ১৯৪৭-এ। বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাঝেই বাঙালি বারবার অকাল বসন্ত উদ্‌যাপন করেছে সংগ্রামে।
এক তরুণী চিকিৎসকের লাশের মেয়াদ বছর ঘুরেছে। তাঁর শেষ ডিনারের এক বছর পেরোতে চলেছে জগৎ সংসার। ‘অভয়া’র ভয়ের রাত মুছে দিয়েছিল গত বছরের ১৪ আগস্ট। এবার, এক বছর পরে সেই অখণ্ড অভ্যুত্থানে সাপের চলার পথের মতো বিভাজন রেখা হাজির করেছে বিজেপি। যেমনটা তারা বরাবর করে। কখনও জনসঙ্ঘ নামে। কখনও আরএসএস হয়ে। কখনো সে হিন্দু মহাসভা। 
কিন্তু ১৪আগস্ট রাতে সে বরাবর হেরে গেছে। হেরে গেছে ১৫ আগস্টের সকালে। 
কার কথা এই সূত্রে বলি? চিন্মোহন সেহানবীশ? চলবে? আমার ধারণা ছুটবে। দেশের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধাদের একজন চিন্মোহন সেহানবীশ দেখেছিলেন ১৯৪৭-এর ১৪-১৫ আগস্ট। দেখেছিলেন টুকরো টুকরো সত্তা কীভাবে ‘গণ’ হয়ে ওঠে উদ্‌যাপনে — বিভেদ মাড়িয়ে। সেহানবীশ জানিয়েছিলেন অমলেন্দু সেনগুপ্তকে। কী জানিয়েছিলেন? ‘১৪ আগস্ট শোনা গেল রায়ট নাকি থেমে গেছে। সত্যি কিনা যাচাই করার জন্যে আমি আর সরোজ দত্ত পাগলের মতো পায়ে হেঁটে সারা কলকাতা ঘুরেছি। প্রথমে ভয় হয়েছিল, পরে ভয় উড়ে গিয়ে এল স্বস্তি—এক অদ্ভুত আনন্দ। এক হিন্দু বিধবাকেও রাস্তায় যেতে যেতে বলতে শুনেছি—পার্কসার্কাস দেখে এলাম—যাই নাখোদা মসজিদ দেখে আসি।’ 
আর? বিভাজন ভেঙেছিল কীভাবে? তাঁরা হাজির হয়েছিলেন গড়পার-রাজাবাজার চত্বরে। ‘একদিকে গড়পারে বিষ্টু ঘোষের আখড়া—হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দুর্গ।’ অপরদিকে রাজাবাজার—পাকিস্তানের দাবিতে মারমুখী একদল ‘মুসলমান গুন্ডা অধ্যুষিত সাংঘাতিক জায়গা।’ সেহানবীশ বলছেন,‘গিয়ে দেখি দু’পক্ষই তোরণ বানাচ্ছে—হিন্দুস্তান-পাকিস্তান দুটি ডোমিনিয়নের জন্ম হচ্ছে। মাঝখানে খানিকটা জায়গা— নো ম্যান’স ল্যান্ড। দু’পক্ষই বোমা নিয়ে সতর্ক সশস্ত্র। একমনে তারা কাজ করে চলেছে। হঠাৎ সাহস করে রাজাবাজারের দিক থেকে এক মুসলমান ছেলে নো ম্যান’স ল্যান্ড-এ এসে চেঁচিয়ে বলল,‘আমাদের একটা হাতুড়ি দিতে পারেন? আমাদের একটা হাতুড়ি দরকার।’ গড়পারের দিক থেকে একজন চেঁচিয়ে বলে উঠল,‘এই নিন হাতুড়ি।’ সে হাতুড়িটা রাজাবাজারের দিকে ছুঁড়ে দিল।’ কাঁটাতার, হিংসা মুছে গেল হাতুড়িতে! কুমুদ বিশ্বাসের বর্ণনায় আর এক বাংলা—‘লরির উপর একটি হিন্দুস্তানি ছেলে নাচছে—আর কেবল বলছে—‘হাম আজাদ হো গিয়া—হাম আজাদ হো গিয়া।’
কোথায় ভাষার ভাগ? কোথায় ধর্মের নামে চোরাদের কাটা ড্রেন শিরায় শিরায়?
বর্ণনা ছাড়া সত্যের কোনও ছবি হয় না। সত্য আর বর্ণনার যৌথজীবন সভ্যতার থেকেও প্রাচীন। যদি সেদিন রাতে আর জি কর হাসপাতালের সামনে ‘অভয়া’র ক্ষতবিক্ষত নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে দ্রুত পলাতক হওয়ার চক্রান্তে থাকা গাড়িটিকে রাজ্যের আলো হয়ে টিকে থাকা যুব আন্দোলন আটকে না দিতো, যদি তাদের প্রতিটি উচ্চারণ ‘ডেসক্রিপশন’ না হয়ে উঠতো পুলিশের মুখোমুখি, তাহলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ভুল প্রমাণ করার কোনও সুযোগ থাকতো আমাদের? কিছু না। 
আমেরিকার আজও ভালো কিছু নেই। গাজা জানিয়েছে। শক্তি এখানে ঠিক। কিন্তু বিনয় এলেও স্পর্ধা এখনও দিনবদলের ঋত্বিক হয়ে বেঁচেবর্তে আছে যৌবনের তর্জনি আর চোখের তারায়—কে জানতো? শক্তি দুঃখ পেতেন ‘অভয়া’র হত্যায়। প্রিয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেহের পাশে আনত শহরের আর এক প্রান্তে নিজের একটি পংক্তি অন্তত ভুল প্রমাণিত হয়ে যাওয়ায় সেই শক্তিই খুশি হতেন। কারণ—সব ‘ব্রাত্য’ হয়ে যায়নি। ‘ঘটক’ এখনও বেঁচে আছেন। আমার শহর, গ্রাম এখনও জেগে উঠতে পারে রাতের দখল নিতে। গত ১৪ আগস্ট দেখিয়েছে। এবার আবার তা দেখিয়ে দিতে হবে। এ’ দায়িত্ব আমাদের। 
শঙ্খ ঘোষ কী বলেছিলেন মনে আছে? আসুন একত্রে উচ্চারণ করি—‘‘কুন্ডলিত রাত্রিটা আজ যাবার সময় বলল আমায়/‘তুমিই শুধু বীর্যহারার দলে,/ঋজু কঠিন সব পৃথিবীর হাড়ে-হাড়ে ঘষা লেগে/অক্ষমতা তোমার চোখের পলে।’/ নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী/আমার হাড়ে পাহাড় করা জমা—/মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে/অস্ত্র গোড়ো, আমায় কোরো ক্ষমা।’’ 
কিন্তু ‘ক্ষমা’ নেই। সুযোগ নেই ‘ক্ষমা’ করার। ‘ক্ষমা’ চাওয়ার। সুদীপ্ত গুপ্ত, আনিস খান, ‘অভয়া’ থেকে তামান্না— শাসকের প্রতিটি খুনের জবাব চেয়ে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে আমার রাজ্য। প্রতিটি প্রাণ ‘মানুষ হবার যজ্ঞ’-র জন্য দান করেছে হাড়। অস্ত্র আজ প্রতিটি হৃদয়ে। সে ভাণ্ডার বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। তার কোনও বিভক্তি হয় না। আজ মাত্র দুটিই পক্ষ— বিচারের জন্য রাত দখলে কে আছে, আর কে নেই। যিনি এসে দাঁড়াবেন আজ রাতে, নক্ষত্র-খামারের নিচে, তিনি যোদ্ধা। যার দ্বিধা আছে, যিনি শক্তির ভাষায় ‘সম্ভ্রান্ত বিশ্রাম’ বেছে নেবেন এই ক্ষণে, তিনি বেইমান। 
কোনও তৃতীয় শিবির আজ নেই। থাকতে পারে না।

Comments :0

Login to leave a comment