SANDESHKHALI RESISTANCE

শাহজাহানের পাড়া খোঁজ নিল, দ্বীপ জানালো ‘আমরা লড়ব’

রাজ্য

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP

চন্দন দাস ও প্রবীর দাস: সন্দেশখালি
 

‘মীনাক্ষীরা এয়েচিল শুনলাম। সত্যি এয়েচিল।’ আকুঞ্জিপাড়ার মুখে এই প্রশ্ন শুনে মোবাইলে ছবি তোলাকে বিরতিতে পাঠাতে হলো।
‘সন্দেশখালির ত্রাস/তার আকুঞ্জিপাড়ায় বাস।’ সেই ত্রাস পলাতক। আপাতত। প্রায় ৫০দিন। সন্দেশখালি নদী পাড় থেকে মালঞ্চমুখী রাস্তার পাশে আকুঞ্জিপাড়া। সিধে রাস্তা চলে গেছে গ্রামের মধ্যে। রাস্তার মুখে গত জুনে লাগানো ফেস্টুন রোদ, বৃষ্টিতে কিছুটা ফ্যাকাসে। কিন্তু ফেস্টুনের বাক্যক’টি আর ছবি তিনটি এখনও বেশ স্পষ্ট— ‘আসন্ন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্দেশখালি-২নং ব্লকের ৫২নং জেলাপরিষদ আসনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ ধন্য এবং সন্দেশখালির উন্নয়নের কাণ্ডারি জননেতা তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী— সেখ শাহাজাহান কে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন।’ ফেস্টুনের উপরে নিচে তৃণমূলের প্রতীক। বাঁদিকে মমতা ব্যানার্জির দু’টি ছবি। কেন কে জানে! তার পাশে হাতজড়ো করা মহাপুরুষের ধাঁচে অভিষেক মুখমণ্ডল। আর উলটো দিকে ‘জননেতা’, ‘উন্নয়নের কাণ্ডারি’ সেখ শাহজাহানের ছবি। নিচে প্রচারের দাবিদার হিসাবে লেখা— বেড়মজুর-২ অঞ্চল তৃণমূল কংগ্রেস।
শনিবার সন্দেশখালিতে ১৪৪ধারার মধ্যে রাজ্যের দুই মন্ত্রী, সুজিত বসু আর পার্থ ভৌমিক গেছিলেন লঞ্চ চেপে কর্মীসভা করতে। পুলিশ বাধা দেয়নি। বরং ‘প্রোটেকশান’-র প্রভূত ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু বেড়মজুর-২নং অঞ্চলের কোনও তৃণমূল নেতা যাননি সেই সভায়। তারা এলাকায় নেই, তা নয়। কিন্তু চুপ করে আছে। 
কে বললেন? আকুঞ্জিপাড়ার ওই মহিলা বললেন। যিনি ছবি তুলতে দেখে, সাংবাদিক ভেবে প্রশ্ন করলেন— ‘মীনাক্ষী এয়েচিল শুনলাম। সত্যি এয়েচিল?’
তখন বিকাল প্রায় শেষের মুখে। চ্যানেলে চ্যানেলে মীনাক্ষী মুখার্জি সহ ডিওয়াইএফআই নেতাদের পুলিশকে স্রেফ বোকা বানিয়ে সন্দেশখালিতে ঢুকে পড়া, টের পেয়ে পুলিশের বিশাল বাহিনী নিয়ে সেই কয়েকজনকে আটকাতে ছুটে যাওয়া, ধ্বস্তাধ্বস্তি, যুব নেতৃত্বদের একবার মাঝেরপাড়ায় আর একবার সন্দেশখালি ফেরিঘাটে প্রতিবাদে বসে পড়ার মতো ঘটনাবলীর সম্প্রচার হয়ে গেছে। তবু মহিলা জানেন না? খটকা লাগল।
আপনি টিভি দেখেননি? টিভিতে তো দেখাচ্ছে। প্রশ্নের উত্তরে মহিলা বললেন,‘টিভি দেখার সুযোগ কোথায়? কাজ থাকে না? শুনচিলাম গেরামের লোক বলছিল। সত্যি এয়েচিল? তুমি দেখেচ?’
পিছনে সাদা পাঞ্জাবী পড়া ‘সন্দেশখালির ত্রাস।’ তবে এখন ফেস্টুনে। কারণ— সেখ শাহজাহান এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আকুঞ্জিপাড়ার মুখে একটি বাড়ির দোতলার ছাদে কাজ করছিলেন তিনজন শ্রমিক। তারাও দাঁড়িয়ে আছেন— জবাবের অপেক্ষায়। ‘হ্যাঁ এসেছিল। এই তো গেল এখান দিয়ে। বসিরহাটে।’ এই টুকু বলে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। 
কারণ— সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সন্দেশখালি যে ঘটনাবলীর সাক্ষী হয়েছে, তার কোনও সাম্প্রতিক উদাহরণ নেই। এই কথা একবাক্যে সবাই বলছেন। 
ঘটনার শুরু সকালে। ঘড়িতে তখন প্রায় সওয়া সাতটা। ধামাখালি আর সন্দেখালির মাঝে নদী— ছোট কলাগাছী, বিদ্যাধরী আর রামপুর নদী এখানে মিলেছে। ধামাখালি থেকে ৩টাকার খেয়ার ভাড়া কেটে, নীল টিকিট নিয়ে ভুটভুটিতে উঠতে হয়। ধামাখালি ঘাটের মুখেই টেবিল পেতে ভোর থেকে বসে থাকে টিকিট দেওয়ার দু’জন। তখন কয়েকজন পুলিশও সেখানে ছিলেন। তাদের সামনে দিয়ে শাড়ি পড়া, মাথা মুখ সাদা ওড়নায় কিছুটা ঢাকা ডিওয়াইএফআই রাজ্য সম্পাদক হেঁটে গিয়ে খেয়ায় উঠে পড়েন। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহাও একই নৌকায় উঠেছিলেন। তবে তিনি আলাদা গেছিলেন। একে অপরের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। পুলিশ, খেয়াঘাটের কর্মীরা, নৌকার সহযাত্রীরা— কেউই কিছু বোঝেনি। ওপারে, সন্দেশখালি ঘাটেও পুলিশ ছিল। তারাও কিছু আন্দাজ করতে পারেননি।
পুলিশ ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন ও বর্তমান নেতৃত্বর পথ আটকেছে সকাল সাড়ে ১১টার পরে— মাঝেরপাড়ায়। সেখানে মীনাক্ষী মুখার্জি, ধ্রুবজ্যোতি সাহা ছাড়াও সংগঠনের নেতা শফিকুল সর্দার, পারমিতা চৌধুরি, সপ্তর্ষি দেব প্রমুখ ছিলেন। ছিলেন ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন নেতা পলাশ দাসও।
তার আগে ডিওয়াইএফআই রাজ্য সভাপতি এবং সম্পাদক টোটোতে, হেঁটে পৌঁছে যান দ্বীপের প্রায় আর এক প্রান্তে। তাঁরা কাণ্ডারপাড়ায় প্রথম গেছিলেন। সেখান থেকে কর্ণখালি আদিবাসীপাড়া, দাসপাড়া, পাত্রপাড়া, কলোনী পাড়া, আদিবাসী পোল পাড়ায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। কীভাবে সেখ শাহজাহানের বাহিনী ভয় দেখিয়ে জমি লুট করেছে, জোর করে ভেড়ি বানিয়েছে, তার অনেক ঘটনা তাঁরা যুব নেতৃত্বকে জানান। আবাস যোজনার ঘরের জন্য কাটমানি নিয়ে ঘর না দেওয়া, একশো দিনের কাজের টাকা থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ প্রায় প্রত্যেক ঘরে। এই পাড়াগুলির মধ্যে দু’টি এলাকা আছে, যেখানে গরিব মানুষের বসবাস বেশি। মহিলাদের দলের কার্যালয়ে ডেকে তৃণমূলী নির্যাতনের অভিযোগ প্রায় প্রতিটি পাড়ায় মিলেছে। ১৮৭জনের বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়েছে তৃণমূল-পুলিশ। এর বিরুদ্ধেও ক্ষোভ জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তবে একটি উপাদান সর্বত্র এক। প্রতিটি পাড়ার মানুষ, বিশেষত মহিলারা বলেছেন,‘‘আমরা লড়ব। বিচার চাই শাহজাহানদের।’’
মাঝের পাড়ায় একটি বাড়িতে স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন যুব নেতৃত্ব। বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। যুব নেতৃত্ব দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার এজেএ রহমানকে পথ আটকানোর কারণ জানতে চান। ওই মহিলা আধিকারিক কেন পথ আটকেছেন তার কারণ বলতে পারেননি। কোনও লিখিত নির্দেশও দেখাতে পারেননি। বারবার এই প্রশ্নে তিনি নির্বাক ছিলেন। শুধু বলেন,‘এখান থেকে আপনারা কোথাও যেতে পারবেন না।’ যুব নেতৃত্ব এগনোর চেষ্টা করলে তাঁদের রুখতে ধাক্কা দেয় পুলিশ, র্যা ফ। এরই মধ্যে মহিলা র্যা ফ কর্মীদের মুখ ঢাকা এবং পোশাকে কোনও নাম না থাকায় যুব নেতৃত্ব প্রশ্ন করেন,‘আপনারা কী পুলিশ? নাকি তৃণমূলের কর্মী পুলিশের পোশাকে এসেছেন?’ এই প্রশ্নেরও কোনও জবাব দিতে পারেননি। পুলিশের এই আচরণের প্রতিবাদে মাঝেরপাড়ায় যুব নেতৃত্ব বসে পড়েন। বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে সেখান থেকে তাঁরা মিছিল করে সন্দেশখালি ফেরিঘাটের কাছে যান। সেখান থেকে সন্দেশখালি থানায় যেতে চাইলে পুলিশ ফের তাঁদের আটকায়। সেখানেই যুব নেতৃত্ব বসে পড়েন ফের। পুলিশের অজুহাত ছিল ‘১৪৪ধারা আছে।’ যদিও ফেরিঘাটে যখন যুব নেতৃত্ব অবস্থান করছেন, তখনই দু’টি নৌকায় তৃণমূলের কর্মীরা ১৪৪ ধারা ভেঙে সন্দেশখালির মেলার মাঠে দলীয় সভায় যান।
সন্দেশখালিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন,‘‘আমরা সন্দেশখালি থানায় যেতে চাইলাম। পুলিশ যেতে দিল না। দীর্ঘক্ষণ আমাদের আটকে রাখল। পুলিশ কী চাইছে? তবে কী সন্দেশখালি থানাতে পুলিশ শেখ শাহজাহানকে লুকিয়ে রেখেছে? সন্দেশখালির মানুষ ভালো নেই। তাদের জীবন জীবিকা লুট হয়েছে। চাষের জমি দখল করে মেছোঘেরি বানিয়েছে শেখ শাহজাহান শিবু হাজরা উত্তম সর্দাররা। নদীর নোনা জল ঢুকায়ে দিয়েছে চাষের জমিতে। মহিলাদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে।’’
সন্দেশখালি থেকে যুব নেতৃত্ব যান বসিরহাটে। সেখানে পুলিশ সুপার(বসিরহাট) হোসেন মেহেদি রহমানকে ডেপুটেশন দেন যুব নেতৃত্ব।

 

Comments :0

Login to leave a comment