অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যে গর্বিত ভারত স্বস্তি ও তৃপ্তিবোধ করছে। একাংশ তো শত্রু নিধনে আত্মহারা। কেউ কেউ তো আবেগ বাহুল্যে মাতোয়ারা হয়ে উৎসবে মেতেছেন। পহেলগামে ২৬ ভারতীয়র মৃত্যুর বদলায় পাস্তিানের ৯টি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে গুঁডিয়ে দিয়েছে মোদীর ভারত। সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহৃত কিছু মসজিদ, বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু একজন সন্ত্রাসবাদীরও মৃত্যু হয়েছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। বিপরীতে পাকিস্তান ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে। তবে সকলেই নাকি শিশু মহিলা সহ সাধারণ মানুষ। অবশ্য জইস-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজাহার জানিয়েছেন ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাঁচ শিশু সহ তার পরিবারের ১০জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সন্ত্রাসবাদী যোগ আছে এমন কেউ মারা গেছে বলে কোনও তথ্য মেলেনি। এই অবস্থায় বদলা নেওয়া হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য দাবি করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা পহেলগামে যে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে তারা কিন্তু এখনও অধরা। তারা কি এখনও কাশ্মীরে লুকিয়ে আছে, না পাকিস্তানে চলে গেছে অথবা অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে তার কিছুই জানতে পারেনি মোদী-শাহ-র গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাবাহিনী। এই খুনিদের যদি ধরা যেত অথবা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নির্মূল করা যেত তাহলে অন্তত বলা যেত বদলা নেওয়া হয়েছে এবং ২৬ নিহতকে বিচার পাইয়ে দেওয়া গেছে। আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার ২২ এপ্রিল পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হানার পর দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল এবং ভারতের তরফে পাক ভূখণ্ডে পালটা সামরিক হামলার প্রস্তুতি যেভাবে জোরদার হচ্ছিল সর্বোপরি যে কোনও মূহুর্তে ভারত হামলা চালাতে পারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন পাক সন্ত্রাসবাদীরা সীমান্ত ঘেঁষা তাদের ঘাঁটিতে নিশ্চিন্তে বসে থাকবে এমনটা কোনও নির্বোধও ভাবতে পারে না। তাই সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে সেগুলি গুড়িয়ে দিলে তাকে আর যাই হোক সন্ত্রাসবাদ দমন বলা যায় না। সন্ত্রাসবাদ দমন বা নির্মূলকরণ অনেক বড় ব্যাপার। সন্ত্রাসবাদীদের কিছু কাঠামো ভাঙলে আবার কোথাও গডে নেওয়া কঠিন কাজ নয়।
অপারেশন সিঁদুর নিঃসন্দেহে একটি বড়সড় পদক্ষেপ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা বদলা নিয়েছি। আর ওরা আমাদের ওপর আঘাত হানার সাহস পাবে না। এমনটা বাজার গরম করার মেঠো ভাষণ হতে পারে তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। এমন গরম ভাষণ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোটে বোমাবর্ষণের সময়ও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তাতে জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী তৎপরাতা ও কার্যকলাপ কিছুমাত্র কমেনি। বরং নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়েছে। পহেলগামের প্রতিক্রিয়ায় অপারেশন সিঁদুর হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে গায়ের ঝাল মেটানো যায় কিন্তু তাতে মূল সমস্যার সমাধান হয় না। যতবার এভাবে সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ধ্বংস করা হবে ততবার ওরা বানাবে এবং যথারীতি জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাবে। আবার এমন অভিযান বাড়াবাড়ির পর্যায় গেলে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। সেটা কোনও দেশের পক্ষেই ভাল হতে পারে না। বিশেষ করে তার চরম মূল্য চোকাতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তাই অস্ত্র দিয়ে এবং যুদ্ধ করে সমাধান কোনোদিন মিলবে না। ওটা শান্তির পথে আলোচনার মধ্য দিয়েই আসবে। পাশাপাশি তাকাতে হবে ঘরের দিকে। সীমান্তে নজরদারি ও নিরাপত্তায় দক্ষতা বাড়াতে হবে। সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশ শূণ্যে নামাতে হবে। সীমান্ত পারের সন্ত্রাসবাদীরা যদি ঢুকতে না পারে তাহলে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ দুর্বল হয়ে যাবে। অতপর কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাদের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তাদের আবেগ অনুভূতি, দুঃখ, যন্ত্রণা, চাওয়া-পাওয়া উপলব্ধি করতে হবে। তাদের সংহত করতে হবে গোটা দেশের সঙ্গে। দেশ, রাষ্ট্র শুধু জমি-মাটি বা পুলিশ, মিলিটারি দিয়ে তৈরি হয় না। তার প্রধান উপাদান মানুষ। মানুষের ভালোর জন্যই সব কিছু। তাদের বাদ দিয়ে তাদের অবিশ্বাস করে আর যাই হোক কোনও সফল রাষ্ট্র গড়া যাবে না। সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ভাবনা বিভাজন, অবিশ্বাস, সন্দেহই তৈরি করতে পারবে, ভারতকে কোনোদিন জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসতে পারবে না।
Editorial
বদলা তো হলো তারপর

×
Comments :0