RG Kar Doctor

চারদিন পরেও আর কাউকে গ্রেপ্তার নয়

রাজ্য


‘বদলি’ হওয়া অধ্যক্ষকে চারদিন পরেও জেরা করল না কেন পুলিশ?
‘ভিতরের কোন প্রভাবশালী’কে আড়ালের চেষ্টা?
পরিকল্পিতভাবেই কী মৃতাকে ‘লক্ষ্যবস্তু’ করা হয়েছিল?
ধর্ষণ করেই খুন- জানাচ্ছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট
তাহলে ‘নেক্রোফেলিয়ার’ তত্ত্ব  নামানো হলো কেন?
---------------------------------------------
নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ১২ আগস্ট— তদন্তের উপসংহার কী পরিকল্পিত? 
হাসপাতালে কর্মরত তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার তদন্তে কী কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাই তদন্তের গতিকে শ্লথ করতে বাধ্য করেছে? সোমবারও মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুলিশ’ কলকাতা পুলিশ তাই কী অন্যতম অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার চারদিন পরেও সম্ভাব্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থ কোনও অভিযুক্তের খোঁজ পেল না? আসলে জিইয়ে রাখা রহস্য ও প্রশাসনের সন্দেহজনক আচরণই আসলে গোটা রাজ্যের চিকিৎসক সমাজকে ছাত্র-যুবকে প্রতিবাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। 
গ্রেপ্তারির পরে জেরা শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে ‘মানসিকভাবে বিকৃত’ বলে দাবি করা ধৃত সিভিক গোটা অপরাধের ঘটনা নাকি স্বীকার করে নিয়েছিল। শুধু দোষ স্বীকারই নয় তাকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হোক সেই কথাও নাকি জানিয়েছিল সিভিক। আরও এক ধাপ এগিয়ে পুলিশের তরফে ভাসিয়ে দেওয়া বয়ান হলো- ধর্ষণের পরে ওই সিভিকই খুন করেছিল তা স্বীকার করেই ঐ সিভিক বলেছিল না হলে চিৎকার করে লোকজনকে জানাতো ঐ তরুণী চিকিৎসক। এই সবই পুলিশি জেরার মুখে বলছে ধৃত সিভিক অথচ আর কেউ তার সঙ্গে ছিল কীনা, মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো ‘যদি ভিতরের কেউ থাকে’ সেটুকু শুধু পুলিশ থেকে জানতে পারছে না গত চারদিনে। কলকাতা পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তাঁদের কাছেও গোটা বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়। 
পরিণাম, তাই চারদিন পরেও কলকাতা শহর তথা গোটা দেশে সাম্প্রতিককালে অন্যতম ঘৃণ্য, নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে চারদিন পরেও তদন্তে গতি পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে পারেনি। চারদিন পরেও ধৃতের সংখ্যা এক। সম্ভাব্য অভিযুক্ত এমন কাউকে আটক পর্যন্ত দেখায়নি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠছে একগুচ্ছ। 
গোটা রাজ্য জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া, আর জি কর সহ একের পর এক মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র, ইন্টার্ন, চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, প্রতিবাদ বিক্ষোভ অবস্থানের মধ্যেই এদিন লালবাজারে আর জি করের সাতজনকে তলব করেছিল পুলিশ। সকাল এগারোটা থেকে দফায় দফায় চলে জেরা পর্ব। সোমবার জেরার জন্য আর জি করের মোট ৭ জনকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল লালবাজারে। এঁরা ঘটনার দিন ‘অন ডিউটি’ ছিলেন। রোস্টারে এদের নাম ছিল। এঁদের মধ্যে চার জন এক সঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছিলেন। বাকি তিন জনের সঙ্গে ঐ চারজনের সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যে দেখা হয়েছিল বা যোগাযোগ হয়েছিল। এদের সকলের সঙ্গে তদন্তকারীরা আগে হাসপাতালে কথা বলেছিল। প্রয়োজনে এদের আগামীকাল আবারও ডাকা হতে পারে। পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে এর আগে হাসপাতালে কর্মরত সিভিক এবং পুলিশ মিলিয়ে গতকাল পাঁচজনের বয়ান নেওয়া হয়েছে। মূলত ধৃত সিভিক সঞ্জয়ের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে তাঁদের তলব করা হয়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গোটা ঘটনায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষকে এখনও পর্যন্ত, চারদিন পরেও সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি আর জি কর কাণ্ডে গঠিত কলকাতা পুলিশের সিট! ইতিমধ্যে এদিন সকালে একপ্রস্ত নাটক করে ‘ইস্তফা’র কথা ঘোষণা করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী যদিও বলেন ‘বদলি’। সন্ধ্যার মধ্যেই ‘ইস্তফা’ দেওয়া কার্যত তৃণমূলের কর্মীতে পরিণত হওয়া ডাঃ সন্দীপ ঘোষকে আবার ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদে বসানো হয়। তবে আন্দোলনরত চিকিৎসকরা সন্ধ্যার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছে। যার মেয়াদকালে আর জি কর হাসপাতালে এমন নৃশংস ঘটনা, যিনি এমন ঘটনার পরেও ‘রাতে মেয়েটি কেন একা ঘরে থাকবে’র মতো অসংবেদনশীল প্রশ্ন তুলেছে তাঁর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন চিকিৎসকরা। 
এখানেই  প্রশ্ন, গত কয়েকবছর ধরে যাবতীয় দুর্নীতি, দুষ্কৃতীরাজের আখড়া হয়ে ওঠা আর জি করের এই প্রাক্তন অধ্যক্ষকে কেন তদন্তের আওতার বাইরে রেখে উলটে পুরস্কারস্বরূপ আরেকটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদে বসানো হচ্ছে? পাকাপাকিভাবে তাঁকে তদন্তের আওতা থেকে আড়ালে রাখতেই কী মুখ্যমন্ত্রী বা সরকারের শীর্ষ মহলের এমন তৎপরতা?
এদিকে লালবাজার সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে আর জি করের চেস্ট মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান ও হাসপাতালে সহকারী সুপারকে লালবাজারে ডাকা হয়েছে। জানা গেছে সেদিন চেস্ট মেডিসিনেত বিভাগীয় প্রধানের থেকে ‘জানার পরেই’ সহকারী সুপার মৃতার মাকে ফোন করে বলেছিলেন আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, হাসপাতালে আসুন তাড়াতাড়ি। চারদিন পরে, অধ্যক্ষের খাতায় কলমে বিদায়ের পরে কেন তলব? 
লালবাজারের তদন্তের গতিমুখই ঘটনার রহস্য বাড়াচ্ছে। অপরাধের ঘটনার বিশ্লষণে খোদ কলকাতা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি যেভাবে, যে অবস্থায় অর্ধনগ্ন দেহ উদ্ধার হয়েছে যে তাতে বোঝা যাচ্ছে এটি নিছকই ‘যৌন তাড়না’ থেকে ঘটেনি। তাহলে কী হাসপাতালের ঐ তরুণী চিকিৎসকে ‘টার্গেট’ করেই তাঁর ওপরে অত্যাচার চালানো হয়েছিল? তা কী পূর্ব পরিকল্পিত? অভিযুক্তরা কয়েকদিন ধরেই তাঁর গতিবিধি নজরে রেখেছিল এমনটাই মনে করা হচ্ছে। কোনভাবে তাঁকে ‘শায়েস্তা করা’র লক্ষ্যেই কী সেদিন রাতে অত্যাচার করা হয়েছিল। কোনও রাগ থেকে এই বিপুল ঘৃণা। হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রাতিষ্ঠানিক কোনও দুর্নীতি বা নির্দিষ্ট কারো কোনও ঘটনা বা কোনও চক্রের কথা কী জেনে গিয়েছিল ঐ তরুণী চিকিৎসক? উঠছে প্রশ্ন।
একইসঙ্গে সামনে আসছে আরও তিনটি নাম। তাঁদের গ্রেপ্তারি কেন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঐ তিনজনই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। একজন ইন্টার্ন আছেন। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। বাকুঁড়ায় তাঁর বাড়ি। অধ্যক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে। তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক সদস্য বাকুঁড়া জেলা তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতা। কেন তার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট তিনজন সন্দেহভাজকে এড়িয়ে যাচ্ছে কী লালবাজার? পুলিশের একটি সূত্রেই একটি সিসি টিভির ফুটেজ বিকৃত করা হয়েছে। তা হয়েছে শুক্রবার সকালেই। কোন প্রভাবশালীকে আড়াল করতে? 
এদিকে ইতিমধ্যে সামনে আসা ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট করা হয়েছে ধর্ষণের পরেই খুন করা হয়েছে। যাবতীয় আঘাত, এমনকি যৌনাঙ্গেও যাবতীয় আঘাত সবই খুনের আগে। অর্থাৎ ধর্ষণের পরেই খুন করা হয়েছে। যে পরিমাণ বীর্যরস সহ শরীর থেকে যে পরিমাণ তরল সংগ্রহ করা হয়েছে তার পরিমাণ ১৫১ গ্রাম। অথচ ময়নাতদন্তের রিপোর্টের আগে পুলিশের একটি সূত্রে জানানো হয়েছিল প্রথমে ধাক্কাধাক্কির পরে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের চার তলায় সেমিনার হলে ওই তরুণী চিকিৎসককে শ্বাসরোধ করে খুন, তার পরে নাকি মৃতদেহকে ধর্ষণ করা হয়। মৃতদেহের প্রতি যৌন আকর্ষণ- নেক্রোফেলিয়ার তত্ত্বকে নামানো হয়েছিল পরিকল্পিতভাবেই। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট গোটা শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন মিললেও পেলভিক বোন ভাঙেনি বলেই জানা গেছে। তবে শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন মিলেছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment