Neo Fascism

শিয়রে বিপদ নয়া ফ্যাসিবাদের

সম্পাদকীয় বিভাগ

শ্রেণি শোষণের ভিতের উপর দাঁড়ি‍‌য়ে গড়ে ওঠা নয়া পুঁজিবাদের ইমারত নিজেই নিজের সঙ্কটের জন্মদাতা। সেই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের রাস্তা পুঁজিবাদ খুঁজে বার করে বটে কিন্তু স্থায়ী সমাধান কখনোই সম্ভব হয় না। একটা সময় পর নতুন সঙ্কটের আবর্তে বিপন্ন হয়ে পড়ে। এটাই পুঁজিবাদের ভবিতব্য যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন কার্ল মার্কস। টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত শোষণের চরিত্র বদল করে পুঁজিবাদ যে নতুন নতুন বন্দোবস্ত হাজির করে নয়া উদারনীতি তারই অন্যতম একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পুঁজিবাদের বিকাশ বেশ কিছুটা অগ্রসর হলেও গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে নতুন করে সঙ্কটের আবির্ভাব ঘটে। সেই সঙ্কট থেকে মুক্তির রাস্তা হিসাবে হাজির করা হয় নয়া উদারনীতিকে। ১৯৯১ সালে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নয়া উদারবাদী অর্থনীতিকে। সেই নয়া উদারনীতিও ঘোর সঙ্কটে পড়ে দিশাহারা হয়ে যায় ২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে। ১৯২৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পর এতবড় সঙ্কটে পুঁজিবাদ আর কখনও পড়েনি। হাজার চেষ্টা করেও পুঁজিবাদ ২০০৮ সালের সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এই প্রবহমান পুঁজিবাদী সঙ্কটের মধ্যেই কোভিড অতিমারী পুঁজিবাদী অর্থনীতির খুঁটিটাই নড়বড়ে করে দেয়। এই দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে না পেয়ে এ যুগের পুঁজিবাদ অতীতের ফ্যাসিবাদকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুঁজিবাদের যে স্তরে ইতালির নাজিবাদ বা জার্মানির ফ্যাসিবাদের আত্মপ্রকাশ আজকের পুঁজিবাদ সেই স্তর থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তাই অতীতের ফ্যাসিবাদ হুবহু ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তবে নবরূপে তার আত্মপ্রকাশ ঘটছে অতিদক্ষিণপন্থী রাজনীতির ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে। এটাই আজকের ফ্যাসিবাদ বা নয়া ফ্যাসিবাদ।
অতীতের ফ্যাসিবাদ যেমন শুরুতে নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলে দাবি করতো, নয়া ফ্যাসিবাদীরাও এখন নিজেদের উদারনীতিবিরোধী ও দেশপ্রেমী বলে দাবি করে। এমনকি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলেও দাবি করে। অবশ্য এই অতি দক্ষিণপন্থী নয়া ফ্যাসিবাদদের প্রধান বৈ‍‌শিষ্ট্য তারা বর্ণবিদ্বেষী, জাতি বিদ্বেষী, বিদেশি ও শরণার্থী বিদ্বেষী, এমনকি ধর্মবিদ্বেষী। আর একটি বৈশিষ্ট্য উগ্র জাতীয়তাবাদ। নয়া ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতা দখল করলেও নির্বাচন ব্যবস্থা বজায় রেখে গণতন্ত্রের ধ্বজা ধরে রাখে। আর ভেতর থেকে রাষ্ট্রের প্রতিটি উপাদানকে কুক্ষিগত করে একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করতে চায়। অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয়া ফ্যাসিবাদ দেশের তথা জাতির সম্পদ মুষ্টিমেয় ধনপতির হাতে তুলে দিতে চায়। শ্রম শোষণের হার সর্বোচ্চ মাত্রায় তুলে শ্রমিকের সমস্ত অধিকার কেড়ে, তাদের যাবতীয় সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে মুনাফা সর্বোচ্চ করতে চায়। এর ফলশ্রুতিতেই বিশ্বজুড়ে আয় ও সম্পদের বৈষম্য ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। অল্প কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত হচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় সম্পদ।
ভারতের বুকে মোদী সরকার এবং আরএসএস-বিজেপি এই প্রবণতারই অংশ। ধর্ম ও জাতপাতের বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে এরা অতি দক্ষিণপন্থার রাজনীতিকে পুষ্ট করছে এবং নয়া ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি নির্বাচন কমিশনকে, বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। বিপুল অর্থ দিয়ে মিডিয়াকে প্রভাবিত করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার করে বিরোধী তথা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকে ভীতসন্তস্ত্র করে কোণঠাসা করতে চাইছে। এই ধ্বংসাত্মক শক্তিকে প্রতিহত করতে হলে দরকার শ্রমজীবী সব অংশের মানুষের বৃহত্তর ঐক্য। ২৪তম পার্টি কংগ্রেসকে সামনে রেখে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সম্মেলন পর্বে সর্বস্তরের সম্মেলনে এই ঐক্য গড়ে তোলার বিষয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment