WEST BENGAL BOMB EXPLOSION

বেআইনি বাজি কারখানার রমরমা
কি ‘বোমা শিল্পের’ জন্য?

রাজ্য

bomb blast west bengal egra illegal cracker factory bengali news

অনিন্দ্য হাজরা  

বোমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেই কী বেআইনি বাজি কারখানা টিকিয়ে রাখতে চায় রাজ্য? খাদিকুলের ঘটনার পরে আরও জোড়ালো হয়েছে এই প্রশ্ন। 

কারণ হিসেবে বাজি প্রস্তুতকরকরা জানাচ্ছেন, এরাজ্যে ১০ হাজার বাজি কারখানার মাত্র ৬৩টির লাইসেন্স রয়েছে। 

সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘ সরকার আধুনিক গ্রিন বাজি শিল্পের বদলে বোমা শিল্পকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই এই অবস্থা।’’ 

মঙ্গলবার পূর্ব মেদিনীপুরের এগারার খাদিকুলে বেআইনি বাজি কারখানা বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। গুরুতর জখম অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছেন কারখানার মালিক তথা মূল অভিযুক্ত ভানু বাগ। তাঁর ছেলে এবং ভাইপোকেও সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে। 

এই ঘটনা সামনে আসতেই তোলপাড় শুরু হয়েছে রাজ্য জুড়ে। উঠছে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। এর আগেও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে। সাময়িক হইচইও হয়েছে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সবকিছু থিতিয়েও গিয়েছে। ফের যেই কে সেই। আবার বিস্ফোরণ। আবার মৃত্যু। যাঁদের সিংহভাগটাই গরিব মানুষ। 

বাজি প্রস্তুতকারকদের সংগঠন উৎসব সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক গোবিন্দ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ রাজ্যের ১০ হাজার বাজি প্রস্তুতকারকের মধ্যে লাইসেন্স আছে মাত্র ৬৩ জনের। বাকিদের পক্ষে লাইসেন্স জোগাড়ের শর্ত পূরণ করা অসম্ভব। এই অবস্থায় আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, বাজি হাব গড়ে তুলুন। তাতে একদিকে বাজি শিল্প বাঁচানো সম্ভব। তেমনই বেআইনি এবং বিপদজ্জনক বাজি কারখানার বিপদও মোকাবিলা সম্ভব।’’ 

এদেশে প্রথম বিস্ফোরক আইন জারি হয় ১৮৬৪ সালে। ২০০৮ সালে সেই আইন সংশোধন করা হয়। নতুন আইন অনুযায়ী, বাজি তৈরি করতে লাইসেন্স আবশ্যক। ১৫ কিলো অবধি বাজি তৈরির লাইসেন্স দিতে পারবেন জেলা শাসক। তার বেশি পরিমাণ বাজি তৈরি করতে গেলে পেট্রোলিয়াম অথরিটি বা পেশো’র ছাড়পত্র প্রয়োজন। 

২০০৮ সালের আইন অনুযায়ী, বাজি কারখানার জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম ৩ বিঘে জমি। এছাড়াও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, জলাধার ইত্যদি সুরক্ষা ব্যবস্থার কথাও বলা হয় নতুন আইনে। কার্যত বাজি তৈরিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই বলা হয়েছে ২০০৮ সালের আইনে। 

২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশে আদালত জানায় দেশে তৈরি হওয়া বাজির ফর্মুলা পরিবেশ বান্ধব নয়। পরিবেশ বান্ধব গ্রীন বাজির ফর্মুলা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় ন্যাশনাল ইনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্সটিটিইউট বা নিরি’কে। নিরি ফর্মুলা তৈরি করে। এবং সেই ফর্মুলার দাম ধার্য হয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। 

বাজি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অংশের ব্যাখ্যা, এরাজ্যের ১ লক্ষের কাছে পরিবার বাজি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কুটির শিল্প হওয়ার ফলে বহু ক্ষেত্রেই পরিবারের সমস্ত সদস্য কয়েক প্রজন্ম ধরে এই কাজ করে আসছে। এবং নতুন আইন অনুযায়ী বদল গুলি, যেমন ৩ বিঘে জমি, কিংবা প্রায় ১ লক্ষ টাকা খরচ করে বাজির ফর্মুলা কেনার সামর্থ তাঁদের নেই। কিন্তু পেটের টানে পুরনো ফর্মুলায় বিপজ্জনক ভাবেই তৈরি হয়ে চলেছে বাজি। এবং তারফলে প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা। হচ্ছে প্রাণহানী। 

এবং সমাজে আতশ বাজির যথেষ্ট চাহিদা থাকায় বেআইনি কারখানাগুলিও চলছে রমরমিয়ে। স্থানীয় প্রশাসন সব দেখেও চুপ। সময় সময় রাজ্য পুলিশ এবং রেল পুলিশ তল্লাশি চালায় বটে। অভিযোগ, মোটা ঘুষের বিনিময়ে সেই অভিযানে ইতি ঘটে। এই অভিযোগ রয়েছে খাদিকুলেও।

নিয়ম অনুযায়ী, বাজি কারখানার মেঝে হওয়ার কথা কাঠের। দেওয়াল তৈরি করার কথা হাল্কা কোনও সামগ্রী দিয়ে। যাতে বিস্ফোরণে ক্ষতি কম হয়। একইসঙ্গে বাজি তৈরির ঘরে আলোর সুইচ থাকার কথা নয়। রসায়নিকের গুদাম আলাদা অংশে থাকার কথা। থাকার কথা পর্যাপ্ত পরিমাণে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ইত্যাদি। 

বাজি হাব তৈরি হলে রাজ্যের ১০ হাজার বাজি প্রস্তুতকারক সংস্থাকেই সেখানে জায়গা দেওয়া সম্ভব। কাজও হওয়ার কথা নিয়ম মেনে।  গোটা শিল্পকে নজরদারির আওতায় আনলে বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরির অভিযোগও কমে যাবে নজরকাড়া হারে। একইসঙ্গে পুরনো কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত না করেই আরও কাজের চাহিদা বাড়ানো সম্ভব। 

উৎসব সমন্বয় কমিটির জানাচ্ছে, এই দাবিতে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর এবং ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়। সংগঠনের অভিযোগ, ২টি চিঠিরই প্রাপ্তি স্বীকার টুকু করা হয়নি। 

প্রশাসনের একটি অংশ জানাচ্ছে, সরকারের মনোভাব হচ্ছে, যাঁদের টাকা আছে, ৩ বিঘা জমি আছে, তাঁরা লাইসেন্স জোগাড় করে ব্যবসা করুক। আর গরিব ব্যবসায়ীরা, যাঁরা এক প্রকার বাধ্য হয়েই বেআইনি কারবার চালাচ্ছেন, তাঁদের গ্রেপ্তারির ভয় দেখিয়ে, তাঁদের দিয়ে ‘মশলা’ তৈরি করিয়ে নেওয়া। বোমা বারুদের স্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলা বিলক্ষণ বোঝে ‘মশলার’ মানে। 

এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তামিলনাডুর শিবকাশী থেকে বাজি শিল্পের বিশেষজ্ঞ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের আনিয়ে বাজি হাব তৈরির বিষয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়। বাজি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এরাজ্যের যুবদের একটা অংশকে তামিলনাডু পাঠানোও হয় আধুনিক কৌশল শিখতে। কিন্তু ২০১১’র পর সবটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ 

 

Comments :0

Login to leave a comment