অন্যকথা / মুক্তধারা
প্রফুল্ল রায় - বাংলা সাহিত্যের সিগনেচার
গৌতম রায়
দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলা সাহিত্য কে যারা সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন প্রফুল্ল রায় ।তাঁর প্রয়াণ দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রসূত কথা সাহিত্যিকের দুনিয়াটাকে প্রায় নিঃস্ব করে দিল।
প্রফুল্ল রায় গোটা জীবনে বহু বিষয় নিয়ে লিখেছেন ।ইউরোপের জনজীবন কেন্দ্রিক অনবদ্য উপন্যাস লিখেছেন ।তাঁর লন্ডন কে কেন্দ্র বিন্দুতে দেখে লেখা উপন্যাস পড়লে মনে হয়, লেখক বোধহয় লন্ডনেই বসবাস করেন ।কিন্তু এসব ছাপিয়ে তাঁর বোধের মধ্যে সব সময় কাজ করে গেছে দেশভাগের যন্ত্রনা।
তাই দেশভাগ ঘিরে বাংলা সাহিত্যের সিগনেচার লেখক হয়ে উঠেছিলেন প্রফুল্ল রায় ।দেশভাগ ঘিরে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতির বদলে, কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে সব সময়ে সাধারণ মানুষ ।অখন্ড বাংলা স্মৃতিচারণে বারবার তিনি দেখিয়েছেন; রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থে দেশভাগ চাইলেও, গ্রামবাংলায় হিন্দু -মুসলমান কিভাবে একে অপরের আত্মার আত্মীয় হয়ে বাংলার সংস্কৃতি , সম্প্রীতির ধারাকে বজায় রেখে চলছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যখন বিনষ্ট হচ্ছে , দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তখনও কিন্তু মুসলমানেরা যে এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে এলাকায় বুক দিয়ে তাঁরা আগলাচ্ছেন হিন্দুদেরকে ।আর হিন্দুরা যে এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তাঁরা বুক দিয়ে আগলাচ্ছেন মুসলমানদেরকে।
অখন্ড বাংলার প্রাণের স্পন্দনকে, অর্থাৎ; হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি কে খুব গভীরভাবে দেখবার সুযোগ এবং সৌভাগ্য প্রফুল্ল রায়ের হয়েছিল। তাই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দেশভাগ ঘিরে কখনও একতরফাভাবে মুসলমানকে দায়ী করা বা মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কটু মন্তব্য কিংবা ইঙ্গিত করা -- এটা আমরা কখনও খুঁজে পাই না।
তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ জনজীবন, বিশেষ করে প্রত্যন্ত নদীমাতৃক এলাকার জনজীবন এবং হিন্দু মুসলমানের যৌথ যাপনচিত্র , তাকে চিত্রিত করবার ক্ষেত্রে প্রফুল্ল রায় যে অবদান রেখে গেলেন , তা বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে। বহু ক্ষেত্রে দেশভাগ বা পূর্ববঙ্গ কিংবা হিন্দু মুসলমানের যাপনচিত্র নিয়ে কথাসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে , সমরেশ বসু, দীনেশ চন্দ্র রায়ের মতো ব্যতিক্রমী দু-একজন লেখক ছাড়া প্রায় সকলেই শহরকেন্দ্রিক, নগরজীবন এবং নাগরিক সভ্যতার আখ্যানচিত্রণকেই বেশি জোর দিয়েছেন ।এক্ষেত্রে প্রফুল্ল রায় এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
অবিভক্ত বাংলার মফসসলের বৃত্তান্তের কথা লিখতে গিয়ে একইসঙ্গে অভিজাত এবং খেটে খাওয়া নিম্নবর্গের মানুষদের যাপনচিত্রকে পাশাপাশি তুলে ধরবার মধ্যে দিয়ে সামগ্রিকভাবে বাঙালির যাপনচিত্রের যে ছবি তিনি এঁকেছেন , এমনটা তাঁর সমসাময়িক কালে খুব বেশি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে পাওয়া যায় না ।
প্রফুল্ল রায়ের এইসব লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায় ,অবিভক্ত বাংলাকে কতটা হাতের তালুর মত তিনি চিনতেন , জানতেন।উচ্চবর্ণের ,উচ্চবিত্তের হিন্দু -মুসলমান থেকে শুরু করে, নিম্নবর্গের , নিম্ন বৃত্তের হিন্দু- মুসলমান --প্রতিটি মানুষের জীবনযাপন ঘিরে কতটা গভীর বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে এই ধরনের লেখা সম্ভব, তা প্রফুল্ল রায়ের সৃষ্টি অনুধাবন করলে বুঝতে পারা যায় ।
দেশভাগের আখ্যান নির্মাণেই তিনি নিজের কলমকে থামিয়ে রাখেননি। দেশভাগ উত্তর কালে উদ্বাস্তু জনজীবনের লড়াই, তাঁদের অধিকার বুঝে নেওয়ার সংগ্রাম- সেগুলিও প্রফুল্ল রায়ের লেখায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।উদ্বাস্তু জনজীবন ঘিরে লিখতে গিয়ে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি পরিকাঠামোর নানা ধরনের মর্মস্পর্শী আখ্যান তিনি রচনা করেছেন। এক কথায় বলা যেতে পারে ; কথাসাহিত্যের মধ্যে দিয়ে সমাজবিজ্ঞান এবং সামাজিক ইতিহাসের এক অনবদ্য আখ্যান প্রফুল্ল রায় সৃষ্টি করে গেলেন।
Comments :0