3 Powerful Earthquakes In Turkey

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূকম্পে মৃত ৩৬০০

আন্তর্জাতিক

3 Powerful Earthquakes In Turkey

‘‘চোখের সামনে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বিশাল আবাসন। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেন কারো আর্তি শুনতে পাচ্ছিলাম। আর কিছু বলার মতো শক্তিও নেই। কী হয়ে গেল!’’ তুরস্কের আদানা শহরের এক বাসিন্দা নিজের নামও বলতে পারেননি। স্বর আটকে গিয়েছে। 


তুরস্কেরই আরেক শহর দিয়ারবাকির। পরিবার নিয়ে থাকতেন মুহিত্তিন ওরাকসি। পরিবারের সাতজনই চাপা পড়েছেন। বেঁচে আছেন তিনি একা। হন্যে হয়ে ঘুরছেন, যদি পরিজনদের কাউকে জীবিত খুঁজে পান। 
তুরস্কতেই শুধু নয়, সিরিয়ারও একটি অংশজুড়ে এই যন্ত্রণাই চোখে পড়েছে দিনভর। সিরিয়ার বাসিন্দা ওসামা আবদেল হামিদ ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারেন ভূমিকম্প হচ্ছে। বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি উঠে স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে কোনওরকমে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসি। আর তার ঠিক পরেই বিরাট শব্দে আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ভেঙে পড়ল। আমরা বোধহয় নতুন জীবন পেলাম। আমাদের প্রতিবেশীরা বলতে গেলে কেউই আর বেঁচে নেই।’’ সিরিয়ার পাশাপাশি লেবানন, সাইপ্রাসও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সীমান্তের বেড়া ভেঙে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে সোমবার ভোরে দু’দেশ মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৬০০’র বেশি, ঘুমের মধ্যেই। প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলা পরিসংখ্যান এদিন রাত পর্যন্ত জানিয়েছে, তুরস্কে ১৫৪১ জন এবং সিরিয়ায় প্রায় ১হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকায় রয়েছে শিশুরাও। যদিও দু’দেশের উদ্ধারকারী বাহিনী জানিয়েছে, ভেঙে পড়া ইট-কংক্রিকেটর স্তূপের নিচে কত শত মানুষ চাপা পড়ে রয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। ফলে মৃত্যু আরও বাড়তে পারে। 

মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি মারাত্মক শক্তিশালী এই কম্পন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে একাধিক ঐতিহ্যশালী ইমারতও। পাঁচশো বছরের পুরানো দুর্গ থেকে সুপ্রাচীন গির্জা, এক লহমায় ধুলো হয়ে গিয়েছে। শতাধিক বহুতল ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে হাসপাতালও। গবাদি পশু, বাড়ির পোষ্য সহ বহু পশুরও মৃত্যু হয়েছে। 
রিখটার স্কেলে এদিনের প্রথম কম্পনের তীব্রতা ছিল ৭.৭। মার্কিন জিওলজিকাল সার্ভে জানিয়েছে, ২০ লক্ষের বাসস্থান গাজিয়ানটপ থেকে ১১ মাইল দূরে ছিল এর উৎসস্থল। তুরস্কের বিপর্যয় মোকাবিলা পর্ষদ জানাচ্ছে, স্থানীয় সময় অনুযায়ী ভোর ৪ টে ১৭ মিনিটে খারামানমারাসেও কম্পন অনুভূত হয়, রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৭.৮। আবার দুপুর দেড়টা নাগাদ একাধিক ছোট-বড় অনুকম্পের সঙ্গেই আবার ভূমিকম্প হয়। তখন তীব্রতা ছিল ৭.৬। প্রথম কম্পনে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কিছু বহুতল নতুন করে মাটি কেঁপে ওঠায় ধসে গিয়েছে। এখানেই মৃত্যু হয়েছে হাজারের বেশির। গাজিয়ানটেপের পাশাপাশি সানলুরফা, দিয়ারবাকির, আদানা, আদিয়ামান, মালাতিয়া, ওসমানিয়ে, হাতে, কিলিসের মতো দশটি প্রদেশে ভূমিকম্পের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। দু’দশকের মধ্যে দেশের সবথেকে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় এটি। ২৪ ঘণ্টায় তিনবার ভূমিকম্প হয়েছে। আর তুরস্কজুড়ে কমপক্ষে ১০০টি অনুকম্প হয়েছে। 

তারমধ্যে অনেকগুলি কম্পনের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ছ’য়ের উপর ছিল। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কম্পনের উৎস হলেও তা ছড়িয়েছে উত্তরেও। প্রায় চার হাজার বহুতল ভেঙে পড়েছে। জখম হয়েছেন অন্তত ১০ হাজার। 
প্রবল ঠান্ডা, সঙ্গে বৃষ্টি এবং তুষারাবৃত রাতে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তুরস্কের দিয়ারবাকির থেকে সিরিয়ার আলেপ্পো, হামা শহর পর্যন্ত, ৩৩০ কিলোমিটারেরও বেশি অংশজুড়ে হাজার-হাজার বাড়ি ভেঙে পড়েছে। হাতের ইস্কেনদেরানে উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভেঙে পড়েছে হাসপাতাল। তবে কতজন প্রাণ হারিয়েছেন, তা জানা যায়নি। তুরস্কের একাধিক টিভি চ্যানেলে সরাসরি ঘটনাস্থল থেকে খবর তুলে ধরা হচ্ছিল। সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সেরকমই একটি ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে, বুম নিয়ে রিপোর্টার ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন। আর পিছনে দেখা যাচ্ছে, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে বহুতল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশে যেন শুধু ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খারামানমারাসে উদ্ধারকাজ চলাকালীন একটি ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হচ্ছে দু’জন শিশুকে। আরেকজন শিশু শুয়ে রয়েছে বরফে ভেজা মাটির উপর রাখা স্ট্রেচারে। ইতিমধ্যে একাধিক দেশ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দ্রুত উদ্ধারকাজ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থার জন্য। 


পরপর ভূমিকম্প এবং অনুকম্পের জেরে আতঙ্কে তুরস্কের বিভিন্ন প্রদেশের বাসিন্দারা শহর ছাড়তে শুরু করেন। যার ফলে যানজট তৈরি হয় এবং উদ্ধারকারী দল নির্দিষ্ট জায়গায় সময়মতো পৌঁছাতে পারছে না। সূর্যাস্তের পর থেকে ঠান্ডা আরও বাড়তে থাকায় আশ্রয়হীন বহু মানুষ মসজিদে গিয়ে উঠেছেন। বাড়িগুলি ইটের টুকরোয় পরিণত হয়েছে। খাবার, জল, কম্বলের চাহিদা হুহু করে বাড়ছে। তুরস্কের হাতে এবং আদানার বিমানবন্দরগুলির অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। রানওয়ে ভেগে যাওয়ায় বিমান বাতিল করে দিতে হয়েছে। বিমানবন্দরেও আটকে পড়েছেন অনেকে। গাজিয়ানটেপ, খারামানমারাসেও অসামরিক বিমান পরিবহণ পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তুরস্ক এয়ারলাইন্স ঘোষণা করেছে, ভূমিকম্প বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে অতিরিক্ত বিমান চালানোর ব্যবস্থা করা হবে। ভূমিকম্পের কারণে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ লাইনও ভেঙে গিয়েছে। খারামানমারাস, হাতে, আদিয়ামান, মালাতিয়া প্রদেশে সমস্ত স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে আগামী দু’সপ্তাহের জন্য। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ খারামানমারাস, আদানা, মালাতিয়া, আদিয়ামান, সানলুরফা, দিয়ারবাকির, গাজিয়ানটেপ, কিলিসি, ওসমানিয়েতে। দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সমস্ত ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সিরিয়া থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী চলে এসেছিলেন তুরস্কে। তাঁদের জীবন এদিনের পর আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।


সিরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশ এবং অন্যদিকে বিরোধীদের দখলে থাকা অংশ- দু’জায়গাতেই ভূমিকম্প প্রভাব ফেলেছে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আজমারিন একদম তুরস্ক সীমান্ত লাগোয়া। পাহাড় ঘেরা এই শহরের ছবি-ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে, বহু শিশুর দেহ বের করে আনা হচ্ছে ধ্বংসাবশেষ থেকে। কম্বলে মোড়া দেহগুলি পাঠানো হচ্ছে হাসপাতালে। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল রাতে। ওই অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছে। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশ সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদিনের বিপর্যয়ে। বিভিন্ন শহরে এবং গ্রামে শয়ে শয়ে বাড়ি ভেঙে পড়েছে। বহু পরিবার চাপা পড়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। সিরিয়াতেও একইভাবে এলাকা ছেড়ে পালানোর হিড়িক উঠেছে। আলেপ্পো, লাটাকিয়া, হামা, তারতুসে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তুরস্ক এবং সিরিয়ার বিধ্বস্ত অংশে বিদ্যুৎ পরিষেবাও ব্যাাহত হয়েছে। 

 


বিশ্বের ভূমিকম্প প্রবণ দেশের মধ্যে তুরস্ক অন্যতম। ১৯৯৯ সালে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি প্রাণ হারান। শুধু ইস্তানবুলেই মারা যান ১০০০ জন। তারপরও ছোট-মাঝারি একাধিক কম্পন হয়েছে তুরস্কে। প্রাণহানিও হয়েছে। কিন্তু এদিনের মতো ভয়াবহতা হয়নি।

Comments :0

Login to leave a comment