ড. অসীম দাশগুপ্ত
এ রাজ্যের যে বাজেট পেশ করা হলো তার প্রেক্ষিতে রয়েছে ইদানীংকালে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অরাজকতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং কর্মীনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে, এবং যার ফল হিসাবে রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী এবং একাধিক উপাচার্যও জেলবন্দি হিসাবে রয়েছেন, তা স্বাধীনতার পর এরাজ্যে আগে কখনও দেখা যায়নি। আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও, নিয়ম ভেঙে যেভাবে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, এবং হয়ে চলেছে, তাও আগে কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। এছাড়া, ভারতের মহাগাণনিক (সিএজি) সদ্য যে রিপোর্ট পেশ করেছেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, এরাজ্যের বাজেটের উল্লিখিত অর্থ বরাদ্দ এবং বাস্তবের তার প্রকৃত ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। আর্থিক অরাজকতার এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেই পেশ করা হয়েছে এই রাজ্য বাজেট।
বাজেটের লক্ষ্য
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক; এই বাজেটের মূল লক্ষ্যগুলি কী? রাজ্যের সাধারণ মানুষের স্বার্থে এই লক্ষ্য হওয়া উচিত কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং মূল্যস্তরকে, বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীগুলির ক্ষেত্রে, নিয়ন্ত্রণে রাখা।
কর্মসংস্থানের বিষয়ে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যগুলিরও ক্ষেত্রওয়ারি উল্লেখ করা প্রয়োজন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির অনুসারে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হতো, এবং এর মধ্যে কতটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তারও ব্যাখ্যা দেওয়া হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণটি চোখে পড়ল না এই বাজেটে। এছাড়া নির্দিষ্টভাবে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য— পেট্রোল এবং ডিজেল-এর ক্ষেত্রে— মূল্যবৃদ্ধির পরিলক্ষিত হলেই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তা প্রশমিত করতে রাজ্যস্তরে আরোপিত বিক্রয়কর হ্রাস করা হতো, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি রাখা হতো অনুরূপভাবে কেন্দ্রীয় শুল্ককেও হ্রাস করা। পরিতাপের বিষয়, এই বিষয়গুলির প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই যথেষ্ট চেতনার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে এই রাজ্য বাজেটে। এছাড়া রাজ্যের নিজের কর রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও করণীয় বিষয়গুলি যথেষ্ট ব্যাখ্যা করা হয়নি।
ঋণের বোঝা
রাজ্য সরকারের ওপর যে মোট ঋণ, তা ইদানীংকালে বৃদ্ধি পেয়েছে উদ্বেগজনকভাবে। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনকালের শেষে ঋণের বোঝা ছিল ১.৯২ লক্ষ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে মূল অংশটি ছিল স্বল্প সঞ্চয় সম্পর্কিত ঋণ। আমরা জানি, স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প একটি সর্বভারতীয় প্রকল্প যাতে রাজ্যের মানুষ তাঁদের অর্থ জমা রাখেন নিজেরাই। এক্ষেত্রে সমস্ত রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষই সর্বাপেক্ষা বেশি স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে অর্থ জমা রেখেছেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, কেন্দ্রীয় সরকার তার নিজের স্বার্থে এই স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে সংগৃহীত অর্থ রাজ্য সরকার না চাইলেও তা চাপিয়ে দিত রাজ্য সরকারের ওপরে ঋণ হিসাবে। এই ঋণের জন্যে দায়ী যে বামফ্রন্ট সরকার নয়, তা বারংবার যুক্তি দিয়ে বোঝানো সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার নিজের স্বার্থে তা মানেনি। এরপর রাজ্য সরকারে ঋণের যে অংশটি ১২,৩০০ কোটি টাকা যা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার সহায়তার হিসাবে পরিচিত তার সত্তরভাগই ছিল ঋণ। এছাড়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে যে ঋণ ছিল ৮,৫০০ কোটি টাকা যা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নাবার্ড ইত্যাদি থেকে নেওয়া হতো তাকেও দেখানো হতো রাজ্যের ঋণ বলে। রাজ্য সরকারের ঋণের বাকি অংশটি ছিল বাজার থেকে গ্রহণ করা ঋণ যা তখন ছিল ৯,৫০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে রাজ্য সরকারের এই ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট ৬.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা। এর মূল অংশটিই হলো বাজার থেকে তোলা ঋণ। এই ঋণের দায়ভারটি বহন করতে হবে বর্তমান রাজ্য সরকারকেই।
সর্বশেষে পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাজ্য বাজেটের এই বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি উল্লেখ করা হলেও কি কি পদক্ষেপের মাধ্যমে যে সাম্প্রতিক আর্থিক দুর্নীতি চোখে পড়ছে — শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে, তা প্রশমিত করা প্রয়োজন— সে ব্যাপারে, কোনও উল্লেখই নেই এই বাজেটে, যা উদ্বেগের ব্যাপার।
সর্বশেষে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, মহার্ঘভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সরকারি কর্মী, মাননীয় শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও অন্যান্যদের জন্য, আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যেও, এই মহার্ঘভাতা প্রতিবছরে অন্তত দু’বার প্রদান করা হতো। এরফলে, সেই সময় মহার্ঘভাতার বিষয়ে রাজ্য সরকারের কর্মী ও অন্যান্যদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মীদের ব্যবধান কখনই খুব বেশি থাকতো না।
Comments :0