তিরুবনন্তপুরম, ২৪ জানুয়ারি— জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিসি’র তথ্যচিত্র দেখানো হবে বলে ঘোষণা করেছিল ছাত্র সংসদ। মঙ্গলবার রাত ৯টায় সেই তথ্যচিত্র দেখানো হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল ছাত্ররা। গুজরাট গণহত্যা নিয়ে এই তথ্যচিত্রে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা রয়েছে বলে কেন্দ্র ভারতে এই তথ্যচিত্র দেখানোর ওপরে কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই অবস্থায় জেএনইউ কর্তৃপক্ষ ফরমান দেয় ওই তথ্যচিত্র দেখানো যাবে না। ছাত্ররা জানায়, এই ফরমানের কোনো আইনী ভিত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিধিও লঙ্ঘিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় জেএনইউ কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে এদিন সন্ধ্যা ৮ টা থেকেই সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েক শত ছাত্র এতদসত্ত্বেও ছাত্র সংসদ অফিসের বাইরের মাঠে সমবেত হন। ওই তথ্যচিত্রের লিঙ্ক কয়েক মিনিটের মধ্যে গণহারে পৌঁছে দেওয়া হয় ছাত্রদের মোবাইলে। অন্ধকার ও প্রবল শীতের মধ্যেই এরপরে কেউ কাফেটোরিয়ায় বসে, কেউ খোলা মাঠে বসে, কেউ চেয়ারের ওপরে ল্যাপটপে ওই তথ্যচিত্র দেখতে থাকেন। এরই মধ্যে এবিভিপি-র কর্মীরা পাথর ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু সব কিছু উড়িয়ে দিয়েই জেএনইউ জুড়ে ওই তথ্যচিত্র চলতে থাকে।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেবার পরে ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন এই ফরমান জারি করেছে তার কোনো উত্তর দিতে পারেনি। মতপ্রকাশের অধিকার কাউকে কেড়ে নিতে দেওয়া যায় না।
কেন্দ্রের ফতোয়া উপেক্ষা করে বিবিসি’র তথ্যচিত্র দেখানো হলো কেরালাতেও। ডিওয়াইএফআই এবং এসএফআই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ওই তথ্যচিত্র দেখালো মঙ্গলবার।
বিবিসি টু টেলিভিশনের ‘ইন্ডিয়া: দি মোদী কোয়েশ্চেন’ নামের এই তথ্যচিত্রের প্রথম পর্ব সম্প্রচারিত হয়েছে গত মঙ্গলবার। এই তথ্যচিত্রে গুজরাট গণহত্যার সময়ে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা সম্পর্কে সমালোচনা থাকায় একাধিক ইউ টিউব ভিডিও প্রচার ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি ইউ টিউবের লিঙ্ক থাকায় ৫০টির বেশি টুইটার পোস্ট ব্লক করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতে কার্যত এই তথ্যচিত্রের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই ঘটনাকে ‘সেন্সরশিপ’ বলেই অভিহিত করেছেন বিরোধীরা।
কিন্তু নানা ভাবে এই তথ্যচিত্রের লিঙ্ক পাওয়া যাচ্ছে ভারতেও। ইন্টারনেটের নানা সূত্রেই ইতিমধ্যে তা হাতে এসে গেছে। কেন্দ্রের ফতোয়া স্বৈরতান্ত্রিক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে আক্রমণ বলে চিহ্নিত করে ডিওয়াইএফআই এবং এসএফআই ঘোষণা করেছে, এই তথ্যচিত্র দেখানো হবে। সেইমত কেরালায় পালাক্কাডের ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং এর্নাকুলামের সরকারি আইন কলেজে এদিন এসএফআই এই তথ্যচিত্র দেখায়। তিরুবনন্তপুরম ও এর্নাকুলামের আরও কিছু কলেজে মঙ্গলবার এই তথ্যচিত্র দেখানো হয়। ডিওয়াইএফআই রাজ্যের নানা জায়গায় প্রদর্শনী করে।
স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র আপত্তি জানিয়েছে বিজেপি। দুটি কলেজের সামনে বিজেপি যুব মোর্চা বিক্ষোভ দেখায়। পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিয়েছে। ডিওয়াইএফআই’র কেরালা রাজ্য সম্পাদক ভি কে সানোজ বলেছেন, সারা দেশেই সংগঠন এই তথ্যচিত্র দেখাবে। কেন্দ্র ফতোয়া দিলেও সরকারি কোনও বিবৃতিতে এই তথ্যচিত্র দেখানো ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেনি। ডিওয়াইএফআই মনে করে না এই তথ্যচিত্র দেখানো কোনও ‘দেশবিরোধী’ কাজ। সরকার যা লুকোতে চায় তা এই তথ্যচিত্রে রয়েছে।
এসএফআই’র সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস জানিয়েছেন, সারা দেশে এসএফআই এই তথ্যচিত্র দেখাবে। গণতান্ত্রিক দেশে এই ‘সেন্সরশিপ’ মানা হবে না।
কেরালায় যুব কংগ্রেসও রাজ্যের নানা জায়গায় এই তথ্যচিত্র দেখাবে বলে ঘোষণা করেছে।
বিজেপি’র কেরালা রাজ্য সভাপতি কে সুরেন্দ্রন এই তথ্যচিত্র প্রদর্শন বন্ধের দাবি জানিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁর দাবি, এই তথ্যচিত্র দেখালে দেশের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করার জন্য বিদেশি ষড়যন্ত্রকে মদত জোগানো হবে। কেরালা থেকেই কেন্দ্রের মন্ত্রী ভি মুরলীধরনও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন, এই তথ্যচিত্র দেখানো হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। এই তথ্যচিত্র প্রদর্শনকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা।
অন্যদিকে, ভারত জোড়ো যাত্রায় জম্মুতে সাংবাদিক সম্মেলনে এই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শাস্ত্র পড়ুন, গীতা-উপনিষদ পড়ুন, দেখবেন লেখা আছে সত্য গোপন করা যায় না। সত্য প্রকাশিত হবেই। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে, সংবাদমাধ্যমকে দমন করা যেতে পারে, সিবিআই-ইডি ব্যবহার করা হতে পারে। কিন্তু যা সত্য তা সত্যই। যতই ভয় দেখানো হোক, সত্য প্রকাশ হওয়া আটকানো যায় না।’
এদিকে, প্রশ্ন উঠে গেছে কেন্দ্রীয় সরকার কেন এই তথ্যচিত্র দেখার বা দেখানোয় বাধা দিচ্ছে, তার কোনও ব্যাখ্যা করা হয়নি। যেদিন ইউ টিউব এবং টুইটারকে এই তথ্যচিত্রের লিঙ্ক সরিয়ে নিতে বলা হয়, সেদিন সরকারি কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তথাকথিত ‘সূত্র’ মারফত সেই খবর জানানো হয়েছিল। ২০২১-এর তথ্য প্রযুক্তি আইন অনুযায়ী কারণ জানানো আবশ্যিক। কোনও সরকারি নির্দেশিকাও জারি করা হয়নি। অর্থাৎ সরকারের পুরো কাজের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে।
শুধু দেশেই নয়, ভারত সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে শোরগোল পড়েছে বিশ্বেই। ওয়াশিংটনে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্যচিত্র নিয়ে প্রশ্নের সামনে পড়েছিলেন। প্রাইস বলেন, এই তথ্যচিত্র সম্পর্কে আমার জানা নেই। ভারতের সঙ্গে আমরা একই মূল্যবোধের অংশীদার। আমাদের সম্পর্ক খুব গভীর।
এই তথ্যচিত্র সম্পর্কে মোদী সরকারের স্পর্শকাতরতার প্রধান কারণ গুজরাট গণহত্যার প্রসঙ্গ। ব্রিটিশ সরকারের একটি রিপোর্ট বিশদে দেখানো হয়েছে যা এতদিন প্রকাশ করা হয়নি। জ্যাক স্ট্র ব্রিটেনের বিদেশ মন্ত্রী থাকাকালীন একটি তদন্ত করানো হয়েছিল। সেই তদন্তের রিপোর্টই দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রে। সেখানে স্পষ্টই বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। বলা হয়েছে, যা ঘটেছে তা ‘হিংসার ধারাবাহিক অভিযান’, যা ‘জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দেওয়ার লক্ষণচিহ্ন’। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘যে খবর প্রকাশিত হয়েছে হিংসার পরিমাণ তার থেকে অনেক বেশি’। বলা হয়েছে, ‘মুসলিম নারীদের ব্যাপকভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে।’ ওই হিংসা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হিন্দু এলাকা থেকে মুসলিমদের হটিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে তা মোদীর নির্দেশে হয়েছে।’
অন্যদিকে এই তথ্যচিত্র ‘গভীর ভাবে গবেষণার’ পরে তৈরি বলে দাবি করেছে বিবিসি। বিবিসি’র তরফে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ সম্পাদকীয় মাপকাঠিকে মান্যতা দিয়ে গভীর গবেষণার পরে ওই তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে। ব্যাপক অংশের কণ্ঠস্বর, সাক্ষ্য, বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া হয়েছে। অনেক ধরনের অভিমত রয়েছে। তার মধ্যে বিজেপি’র সঙ্গে যুক্তদের মতামতও রয়েছে। ওই তথ্যচিত্রে উত্থাপিত বিষয়ে তাদের জবাব দেবার জন্য ভারত সরকারকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা উত্তর দিতে অস্বীকার করে।
Comments :0