BENGALI MIGRANT WORKERS

তৃণমূল কাজ দেয়নি, বিজেপি দেয়নি সম্মান, বেঙ্গালুরুর মিনি বাংলায় আতঙ্ক আর যন্ত্রণা

জাতীয় রাজ্য

CITU migrant workers থুবরাহালি এলাকায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ঝুপড়ি

সত্যব্রত ভট্টাচার্য: বেঙ্গালুরু

নিজের রাজ্যে কাজ নেই, আর এখানে নেই কোনও নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার- হাহাকার আর চোখের জলে ভাসে হাইটেক সিটি সিলিকন ভ্যালি বেঙ্গালুরুর কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবার।
‘পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আমাদের কাজ দেয়নি, আর বেঙ্গালুরুতে বিজেপি দেয়নি কোনও সম্মান, শুধুই ক্রমাগত উচ্ছেদের ভয় আর মিথ্যা মামলা, কথায় কথায় বাংলাদেশি তকমা, আর হিংস্র পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েই কি জীবন কাটবে?’ প্রশ্ন, ললিতা সাঁতরা, সুফিয়া বেগম, পরেশ, সামাদদের।


উত্তর খুঁজতে বেঙ্গালুরু শহরের গান্ধীনগর ম্যাজেস্টিক থেকে যেতে হয়েছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে থুবরাহালি, ভারথু অঞ্চলে। এ যেন অন্য এক জগৎ। অবর্জনাময় পরিবেশে সারি সারি ১০ বাই ১২ টিন আর বাঁশ- বেতের ঝুপড়িসম ঘর দিয়ে ঘেরা এক মিনি পশ্চিমবঙ্গ।


বেঙ্গালুরু শহরে একদিকে চলছে সিআইটিইউ সর্বভারতীয় সম্মেলন। সে খবর পৌঁছেছে সেই মিনি পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচেও। তাঁদের জীবন যন্ত্রণার কথা সম্মেলন কক্ষে পৌঁছে দিয়েছেন বেঙ্গালুরু সিআইটিইউ নেতা কর্মীরা। লকডাউনের সময়ে পরিযায়ীদের যতটা সম্ভব সাহায্য করেছেন তাঁরা। সিআইটিইউ নামে এবার কিছুটা আশায় যেন বুক বাঁধছেন পরিযায়ীরা। রবিবার প্রকাশ্য সমাবেশেও উপস্থিত থাকবেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই। 


বেঙ্গালুরুর কুন্দরহালি গেট এলাকা পেরিয়ে আরও অনেকটা পথ পেরিয়ে থুবরাহালি এলাকা।  গোটা এলাকা জুড়ে চারদিকে ধুলোর আস্তরণ জমা হয়ে রয়েছে পুরু হয়ে। এবড়ো খেবড়ো পথ দিয়ে কিছুটা যেতে অবর্জনাময় বড় বড় পরিত্যক্ত মহল্লা। তার মধ্যে গায়ে গায়ে লাগোয়া অসংখ্য ঝুপড়ির ভেতরে গাদাগাদি করে হাজার হাজার মানুষ। নেই জল, শৌচাগার, আলোর তেমন কোনও ব্যবস্থা। পাশেই ভারথু এলাকা সহ বেঙ্গালুরুর চারপাশের পরিযায়ীদের বাসস্থান অঞ্চলগুলোতে একই চিত্র। 


এই পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রায় সবই পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর,  দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমানের বাসিন্দা। দম বন্ধ করা সেই সব ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ তুলতেই  কিছুটা দূরে বড় বড় ইমারত আবাসন চোখে পড়ে চারদিকে।  গোটা এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন সিআইটিইউ কর্মী সুমন দাস মহাপাত্র। 
এই পরিযায়ী বাসিন্দাদের কেউ হয়তো কাজের আশায় ঘুরছেন, কেউ কাজ করেন দোকানে, কেউ বা নিরাপত্তা রক্ষীর একটা কাজ কোনোরকমে জোগাড় করেছেন, কেউ দিন মজুর, যখন যেখানে কাজ পান করেন। ইউ রাজমিস্ত্রির হেল্পার,  মহিলারা বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজে নিযুক্ত হন। আছেন গিগ ওয়ার্কাররা।

তবে এক বিশাল সংখ্যক মানুষ শহর ও শহরতলির আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করেন। কেউ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হয়ে মিস্ত্রি হিসাবে কাজ করেন। কিন্তু নিয়মিত মাসিক অর্থের সংস্থান বেশিরভাগ শ্রমিকেরই নেই। ঠিকাদার টাকা পয়সা দিতে চায় না বলে প্রায় সবারই অভিযোগ। আবার মুর্শিদাবাদের যুবক মিজাদের মতো অনেকের বেসরকারি সংস্থার  রিপেয়ারিং-এর কাজে নিযুক্ত অনেকের চাকরি খতম হয়ে গেছে অসুস্থ হয়ে কাজে যেতে না পারার জন্য। 
মুর্শিদাবাদের ইসলাম শেখের কথায় পশ্চিমবঙ্গ আমাদের দেখেনি। গত কয়েক বছর ধরে এই আমাদের ঠিকানা। ঠিকানা বলা ভুল। কারণ আজ এখানে আছি, কালই উঠে যেতে হতে পারে আরও দূরে অন্যত্র কোথাও। এছাড়া আছে যখন তখন বাংলাদেশি তকমা দিয়ে পুলিশের নির্যাতন আর মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে হয়রানি। পুলিশ ৮-১০ মাসের ছোট শিশু সহ অন্তঃসত্ত্বা মা-কেও জেলে নিয়ে মারধর চালায় কোনও কথাই না শুনে। পরিযায়ী পরিচারিকাদের ওপর এসে পড়ে চুরির মিথ্যা আরোপ। পরিস্থিতি সামাল দেন সিআইটিইউ কর্মীরা। রোজই ঘটছে এই ঘটনা। পরিযায়ীদের কথায়, আমরা গোরু ছাগলের মতো বাস করছি এখানে। 


বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে পলাশীর পরেশ সাঁতরা বলেছিলেন, বড় বড় ইমারত গড়া চলছে। তারা থাকতে দেবে কেন। তাই অনেক হুমকি আসে রোজ, উঠেও যেতে হয়। ভাতারের সুফিয়া বেগম জানালেন, আড়াই হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে হাতে থাকে না কিছুই। বাবুদের বাড়ি কাজ করে যা পাই তাই দিয়ে চালাতে হয়। ললিতা সাঁতরার কথায়, ঠিকাদার এখানে অনেক সময়ে ঠিকভাবে টাকা পয়সা মেটায় না। তারা কোম্পানিকে দেখিয়ে দেয়। আর কোম্পানি দেখায় ঠিকাদারকে। মাঝখান থেকে  আমরা ঠিকভাবে টাকা পয়সা পাই না। রোজ রোজ ঝগড়া আর মারামারি ভালো লাগে না। 
পূর্ব বেঙ্গালুরুর ২০টি বসতি অঞ্চলে পরিযায়ীরা রয়েছেন। তাঁদের সমস্যা রয়েছে আরও। এলাকায় ঘুরতে ঘুরতেই নজর পড়লো বহু দূরের নালা থেকে জল এনে কাজকর্ম সারছেন পরিযায়ীরা। স্নান সারেন নালায় গিয়েই। চিকিৎসার ন্যূনতম সরকারি সুযোগ সুবিধাও নেই এলাকায়। শহরে সরকারি হাসপাতাল বলতে যা বোঝায় তাতেও খরচ অনেক।  পরিযায়ীদের পরিবারের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়ানো যেন বিলাসিতা এখানে। সরকারি পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত এই ছেলেমেয়েরা।


এখন কিছু এনজিও'র উদ্যোগে তবু শিক্ষালাভ কিছুটা সম্ভব হচ্ছে বলে জানা গেল পরিযায়ীদের বক্তব্যে। দক্ষিণ বেঙ্গালুরুতেও রয়েছেন পরিযায়ীরা। সেখানে ধর্মের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা কায়েম রয়েছে বলে বক্তব্য শ্রমিকদের। 


সিআইটিইউ নেতা আশাদুল্লা গায়েন বলেন, পশ্চিমবঙ্গে কাজ নেই। আর বেঙ্গালুরুতে ন্যূনতম বেতন পাচ্ছেন না পরিযায়ীরা। নেই অন্য কোনও সরকারি সুযোগ সুবিধা। পরিযায়ী শ্রমিকের হয়ে লড়াই আন্দোলনে রয়েছে সিআইটিইউ। উচ্ছেদ অনেকটাই রোধ করা গেছে। আমরা ওই এলাকাগুলিতে সংগঠনকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছি। যাতে পরিযায়ীদের বিপদে আরও বেশি সাহায্য করা যায়। 

শনিবার সিআইটিইউ সর্বভারতীয় সম্মেলনের আলোচনায় পরিযায়ীদের পরিস্থিতি নিয়ে বলেন আব্দুল জব্বার মণ্ডল। 


শনিবার সম্মেলন মঞ্চে চারটি কমিশন পেপার পেশ হয়। এগুলি হলো অর্গানাইজিং ওয়ার্কার্স ইন মডার্ন ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর- ইম্পর্টেনস অ্যা ন্ড চ্যালেঞ্জস, চেনজিং প্রোফাইল অব এমপ্লয়মেন্ট রিলেশন্স, ওয়ার্কিং ক্লাস ফাইট এগেইনস্ট কমিউনালিজম- নিড ফর কাউন্টার অফেনসিভ,  ইন্টার্নাল মাইগ্রেশন অব ওয়ার্কার্স ইন ইন্ডিয়া অন দ্য কন্টেক্সট অব নিউ লিবারালিজম এন্ড কোভিড ক্যাটস্ট্রোফি। এরপর আলোচনা চলে কমিশন পেপারের ওপর। পরে সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক হয়। রবিবার জবাবী ভাষণ, কমিটি গঠন এবং প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে সম্মেলনের কর্মসূচি।

 

ছবিঃ রবীন গোলদার

Comments :0

Login to leave a comment