Bjp attack Tripura

ত্রিপুরায় প্রাণঘাতী আক্রমণ, অদম্য জেদ পার্টিকর্মীদেরও

জাতীয়

‘বাড়িতে অসুস্থ মা একা পড়ে আছে। বউ আর বাচ্চাকে পাঠিয়ে দিয়েছি মালিকের বাড়িতে। কী যে করবো জানি না।’ কথা বলতে কেঁপে কেঁপে উঠছেন সঞ্জীব দেবনাথ। দক্ষিণ ত্রিপুরার জোলাইবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁর বাড়ি। ভোটগণনা কেন্দ্র থেকে বৃহস্পতিবার আর বাড়ি ফিরতে পারেননি এই সিপিআই (এম) কর্মী। অন্যদের সঙ্গে লুকিয়ে ছিলেন জঙ্গলের মধ্যে। দুই রাত জঙ্গলে থাকার পরে শনিবার ভোররাতে অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে এসেছেন উদয়পুর। সেখান থেকে আরেকটা গাড়ি ধরে শনিবার ন’টা নাগাদ আগরতলায় দশরথ দেব ভবনে। সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির দপ্তরে বামফ্রন্ট আহ্বায়ক নারায়ণ করের কাছে। তিনিও জোলাইবাড়ির বাসিন্দা। 
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে এভাবেই রাজ্যের নানা জায়গা থেকে পালিয়ে আগরতলায় আসছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। পকেটে সামান্য টাকা-পয়সা পর্যন্ত নেই। এক পোশাকে, অভুক্ত। নেতৃবৃন্দ চেষ্টা চালাচ্ছেন আপাতত কোথাও একটা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দেওয়ার। পার্টি রাজ্য দপ্তর, পশ্চিম জেলা কমিটি দপ্তর, ছাত্র-যুব, কৃষকসভা অফিস উপচে পড়ছে ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসা কর্মীদের ভিড়ে। 
তাঁদেরই একজন সঞ্জীব দেবনাথ, সঙ্গী লিটন দত্ত। সঞ্জীব রাবার বাগানের ট্যাপার। সামান্য মজুরির এই কাজে সংসার চালান। আশি ঊর্ধ্ব অসুস্থ মা, স্ত্রী আর সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে নিয়ে সংসার। বললেন, একদিকে সন্ত্রাসের ভয়, ছোট বাচ্চা, তার উপর কোনও টাকা পয়সা নেই- বউটা চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে। আমি তো এখন বাড়ি ফিরতে পারবই না। কাজ না করলে খাবে কি সবাই? সঙ্গী কমরেডকে দেখিয়ে বললেন, ‘তারে পাইলে তো কাইট্যা ফ্যালাইবে।’ লিটন দত্ত জঙ্গী কর্মী, বিজেপি’র বাইক বাহিনীর সঙ্গে গণনার আগের দিন পর্যন্ত সংঘাত করেছেন। ফলে তার উপর রাগ বেশি। কান্নাবোজা গলায় সঞ্জীব বললেন, তেরো তারিখ ছেলেটার মুখেভাত দেওয়ার কথা...। পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলেন নারায়ণ কর, আগে প্রাণে বাঁচো, ভাত খাবে ছেলে। 
কর্মীদের প্রাণ বাঁচানোই এখন চ্যালেঞ্জ পার্টির কাছে। কিন্তু প্রাণ যাচ্ছে। কাঁকড়াবন ঘোষ পাড়ার বাসিন্দা পার্টিসদস্য সুনীল দাসের বাড়িতে শুক্রবার রাতে ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালায় বিজেপি দুর্বৃত্তরা। আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হন প্রৌঢ় সুনীল দাস। সারারাত হাসপাতালেই নিতে দেয়নি বিজেপি দুর্বৃত্তরা। সকালে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। ওই বিধানসভার ইচাছড়ায় গরিব পার্টিকর্মী লক্ষ্মী দাসের বাড়ি আক্রমণ করে ভাঙচুর, তছনছ করে বিজেপি কর্মীরা। তাঁর ৮৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা রবীন্দ্র দাস সেই ধাক্কায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। শনিবার তাঁর মৃত্যু হয়। সেখানের প্রার্থী প্রাক্তন মন্ত্রী রতন ভৌমিক ফোন করে করে আক্রান্ত পরিবারগুলির খোঁজ করছেন। চিকিৎসার ব্যবস্থা বা সর্বস্ব হারানো পার্টিকর্মী-সমর্থকদের টিকে থাকার মতো রসদ জোগাড়ের বন্দোবস্ত করছেন। অধিকাংশ জায়গায় পৌঁছানোর কোনও সুযোগই নেই। বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা কর্মীদের কীভাবে উদ্ধার করা যায়, প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করে সেই কাজ করছেন বিভিন্ন এলাকার পার্টি নেতৃবৃন্দ। 
হরিগঙ্গা বসাক রোডে সিপিআই(এম) পশ্চিম জেলা কমিটির অফিস ভানু ঘোষ স্মৃতি ভবনের হল ঘরে, বৈঠক করার ঘরের মেঝেতে শুয়ে-বসে অজস্র পার্টিকর্মী। তার মধ্যে অল্পবয়সিদের দলটি প্রতাপগড় কেন্দ্রের। গতবার পশ্চিম জেলার ১৪টি আসনের সব জিতেছিল বিজেপি জোট। এবার বামফ্রন্ট-কংগ্রেস মিলে ৫টি আসন পেয়েছে। প্রতাপগড় তার একটা, ফলে সেখানে আক্রমণের তীব্রতা অনেক বেশি। 
যুবকর্মীদের মধ্যে একজনের বার বার মোবাইল বাজছে, দেখে সাইলেন্ট করে রাখছেন। বললেন, ‘মা ফোন করছে। ধরবো না, খালি কান্না করে।’ সায় দিলেন আরেক যুবকর্মী। তাঁরও মা, স্ত্রী আতঙ্কে ফোন করছেন বারবার। ‘ফোন চার্জ দিচ্ছি না। মেসেজ করে দিয়েছি, নিরাপদে আছি। চিন্তা করো না। ফোনে বারেবারে তাদের কান্নাকাটি শুনলে মনটা ঠিক রাখা যায় না।’ যুবকর্মীদের মধ্যে একজন বললেন, ‘কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করেছে বিজেপি’র বাইক বাহিনী। পাঁচ বছর পরে তাদের সব চেষ্টা ভেঙে আমরা জোর করে প্রচারে নামি। চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতাপগড়ে জিতবো। এরপর আমাদের ছাড়বে কেন?’ স্বগতোক্তির মতো জুড়লেন, আমরাও দেখি কত সন্ত্রাস করতে পারে! 
এরমধ্যেই তেলিয়ামুড়া থেকে চলে আসা বেশ কয়েকজন যুবকর্মী সকাল থেকে জেদ ধরেছেন আজই এলাকায় ফিরবো, পার্টি অফিস খুলবো। দেখি কে আটকায়! ভয় পেয়ে থাকলে আরও ভয় দেখাবে। যা হওয়ার হবে, কী আর করবে? মেরে ফেলবে। পার্টিকর্মীদের এই জেদ আর সাহসের মনোভাবকে উৎসাহ দিয়েও পার্টি নেতারা তাদের নিরস্ত করছেন এখনই সন্ত্রস্ত এলাকায় ফেরত যাওয়া থেকে। শনিবার সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব এদিন জেলা শাসক, পুলিশ কমিশনার এবং বিভিন্ন মহকুমা স্তরে প্রশাসনের কাছে সন্ত্রাস-হিংসা বন্ধের দাবিতে ডেপুটেশন দিয়েছে। 
জিরানীয়া, রানির বাজার, চম্পকনগর প্রভৃতি এলাকায় আবার নতুন বিপদ শুরু হয়েছে। শুক্রবার রাতে দুই পক্ষের সঙ্ঘাতে মথা কর্মীদের পালটা মারে বেশ কয়েকজন বিজেপি কর্মী জখম হয়। বিজেপি কৌশলে এই ঘটনাকে বাঙালি-উপজাতিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে প্রচার শুরু করে। আশির দাঙ্গার ক্ষত এখনও এই এলাকায় দগদগে। আক্রান্ত, সন্ত্রস্ত পার্টিকর্মীরা তার মধ্যেই রাত থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে সম্প্রীতি নষ্ট না হয়, ঐক্য অক্ষুণ্ণ থাকে। 
ত্রিপুরায় এই সর্বব্যাপী আক্রমণ, কান্না, হাহাকারের মধ্যেও নজর টানে পার্টির নেতা-কর্মীদের অদম্য জেদ। ছোট্ট এই রাজ্যে আক্রান্ত, রক্তাক্ত হাজারে হাজারে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বছরের পর বছর। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আকছার ছাঁটাই, প্রান্তিক এলাকায় বদলি। রবার বাগান হোক বা রিকশা— রুজির সব সংস্থান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু শত্রুর থেকে শান্তি কেনার চেষ্টা নেই। সমঝোতা করে নিজেকে বাঁচানোর ভাবনা নেই। আদর্শের প্রতি কী অপরিসীম দায়বদ্ধতা। পাঁচ বছর প্রতিটি দিন টানা আক্রমণের পরে ফের নতুন করে হামলার মুখে। এই হিংসা-সন্ত্রাসের চক্রের শেষ কবে জানা নেই, তবু লাল ঝান্ডাকে আঁকড়ে থাকার জেদে কোনও ঘাটতি নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment