পীযুষ ব্যানার্জি: কলকাতা
ঋণের পাহাড় আছে। নতুন ঘোষণা আছে। কিন্তু কর্মসংস্থান নিয়ে কোনও দিশার দেখা নেই রাজ্যের বাজেটে।
ফি বছর বাজেট পেশের পর কত মানুষের কর্মসংস্থান রাজ্য করছে তার তথ্য দিতেন মুখ্যমন্ত্রী। এবার রাজ্য বাজেটে সেই কর্মসংস্থান নিয়ে কোনও তথ্য পর্যন্ত সামনে রাখতে পারেনি রাজ্য সরকার। বাজেট পেশের পর মুখ্যমন্ত্রী শুধু বলেছেন, ‘‘ এই বাজেট কর্মসংস্থানমুখী বাজেট। কোটি কোটি বেকারের কাজ হবে।’’
ঋণজালে জড়িয়ে রাজ্যের আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে সরকারের লক্ষ্য মদ বিক্রি। চলতি বছরে মদ বিক্রি বাড়িয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়তি অর্থ রাজকোষে জমা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে রাজ্য বাজেটে।
মদ বিক্রি করে আয় হবে। কিন্তু মূলধনী খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে। মূলধনী খাতে ব্যয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫২ হাজার কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। ১২ হাজার কোটি টাকার কম খরচ করার অর্থ, এরাজ্যে রাস্তা, সেতু, বাঁধ নির্মাণ সহ স্থায়ী সম্পদ তৈরি থমকে যাবে। তার অবধারিত প্রভাব পড়বে কাজের বাজারে। কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন গরিব মানুষ।
রাজ্যের সরকারি দপ্তরে লক্ষাধিক শূন্যপদ পূরণ নিয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি বাজেটে। রাজ্যের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয় শিক্ষা- সর্বত্র শূণ্যপদ লক্ষাধিক পার করেছে। শিক্ষক নিয়োগের শূন্যপদ এখন এরাজ্যে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাতের হার বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছেছে। অথচ রাজ্যের শিক্ষিত বেকারদের কাজের সুযোগ কীভাবে হবে তা নিয়ে নীরব থেকেছে বাজেট।
ফি বছর গ্লোবাল বিজনেস সামিট করে রাজ্য সরকার। গত বছর এপ্রিল মাসে সেই সামিট হয়েছে রাজ্যে। সেই শিল্প সম্মেলনের ১০ মাস পর রাজ্য সরকার বিধানসভায় আগামী ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরের বাজেট পেশ করেছে। বাজেটে শিল্প সম্মেলনের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ১০ মাস পর সেই সম্মেলন থেকে কত বিনিয়োগ এখনও পর্যন্ত এসেছে, তাতে এরাজ্যের বেকার যুবক, যুবতীদের কতজনের কর্মসংস্থান হয়েছে রাজ্যে, তা নিয়ে একটি কথা লেখা হয়নি। কী লেখা হয়েছে শিল্প সম্মেলন নিয়ে? ‘‘২০২২ সালের ২০ ও ২১ এপ্রিল দ্য বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট-২২ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ ও বিদেশের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির সাথে যৌথ ব্যবসা- বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’’ বাণিজ্য সম্মেলন থেকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে একটি কথাও লেখা হয়নি।
এই সম্মেলনেই যোগ দিয়েছিলেন আদানি গোষ্ঠীর গৌতম আদানি। বাজেটে দেউচা পাঁচামি নিয়ে সরকার কী করতে চায় বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে। কিন্তু বাজেটে তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ নিয়ে একটি শব্দ নেই।
রাজ্যে কাজ নেই। অথচ সেই রাজ্যেই বাজেটে কোষাগারীয় ঘাটতি দাঁড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা। কোষাগারের এই ঘাটতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে একটাই পথ খোলা। তা হলো বাজার থেকে ঋণ নেওয়া। শিল্প নেই। মানুষের হাতে কাজ নেই। কীভাবে কর্মসংস্থান গড়া যায় তার কোনও পরিকল্পনা নেই। আছে শুধু এরাজ্যকে ঋণজালে জড়িয়ে ফেলা।
বামফ্রন্ট সরকারের বিদায়পর্বে এরাজ্যে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ১লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে এই পুঞ্জীভূত ঋণকে মমতা ব্যানার্জির সরকার নিয়ে গেছে ৫লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকায়। চলতি আর্থিক বছরে এখনও পর্যন্ত রাজ্যের মোট পুঞ্জীভূত ঋণ (সংশোধিত) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫লক্ষ ৮৬হাজার ১২৪ কোটি টাকায়। প্রকৃত পুঞ্জীভূত ঋণ কী দাঁড়ালো তারজন্য আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী এক বছরে রাজ্য সরকার বাজার থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
বাজার থেকে নেওয়া ঋণের বহর এখানেই থামছে না। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে রাজ্যের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬লছ ৪৭ ৮২৫ কোটি টাকা। যার অর্থ ৬১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে চলেছে! আর ধার পরিশোধ করতে রাজ্যের খরচ ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। রাজ্যের অনুমিত আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ আসবে বাজার থেকে ধার করা টাকায়। রাজ্যের আর্থিক হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এই তথ্যেই তা স্পষ্ট।
বাজেট পেশ করতে অর্থ মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, রাজ্য সরকার নতুন করে কোনও কর রাজ্যবাসীর ওপর চাপায়নি। আপাতদৃষ্টিতে এটা ঠিকই যে আয় বাড়াতে সরকার নতুন কর বসায়নি। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকার ৮৮ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা রাজস্ব বাবদ আদায় করবে। গত ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার আয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবে যেমন বলা হয়েছে ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে মদ থেকে ১৭হাজার ৯২১ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। গত আর্থিক বছরে যা ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করা হবে মদ বিক্রি থেকে। রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গিয়ে মদের নেশায় কার্যত ডুবিয়ে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। পেট্রোল- ডিজেলের ওপর রাজ্য সরকার যে কর আদায় করে সেই সেল ট্যাক্সে এবারের বাজেটের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। গত বছর যা ছিল ১২ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। ১৭৬৩ কোটি টাকা বাড়তি কর আদায় করা হবে জ্বালানি থেকে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে সরকারের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা।
পেট্রোল ডিজেলের মতোই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের কর ও শুল্ক থেকে এবারের বাজেটে কর আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গত আর্থিক বছরে এই ক্ষেত্রে সরকার আদায় করেছিল ৩হাজার ১২৫ কোটি টাকা। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় হবে বিদ্যুৎ ক্ষেত্র থেকে।
জিএসটি থেকে চলতি আর্থিক বছরে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৭ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। গত বছরের থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি বাড়তি কর আদায়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। এরাজ্যের পথে ঘাটে দু’চাকা, চার চাকার বাহনের ওপর পুলিশের জুলুম নিয়ে অভিযোগ নতুন কোনও ঘটনা নয়। ৩ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা গাড়ি থেকে কর আদায়ের চলতি বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। গত বারের থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা বেশি কর আদায় হবে। ফলে নতুন কর চাপলেও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাই বুঝিয়ে দিচ্ছে জনগণের ওপর করের বিপুল বোঝা চাপতে চলেছে।
Comments :0