Bulldozer victims are demand compensation

বুলডোজার পীড়িতরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতে যাচ্ছেন

জাতীয়

 ‘‘আমার স্ত্রী এবং মেয়েকে পুলিশ হেপাজতে আটকে রাখা হয়েছিল যখন আমাদের দোতলা বাড়িটা বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছিলো।’’ ছলছল চোখে একথা বলছিলেন জাভেদ মহম্মদ। পাম্প সেটের ব্যবসা জাভেদের। ২০২২ সালের ১২ জুন যোগীর প্রশাসন তাঁদের দোতলা বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। বুলডোজার-রাজ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার জাভেদ বললেন, এইরকম স্বেচ্ছাচারীভাবে কারো ঘর ভেঙে ফেলা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্বস্তি পেয়েছি।’’ একই রকম স্বস্তির কথা জানিয়েছেন বরেলির রাজীব রানার মেয়ে অবন্তিকা। তিনি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে আমরা স্থির করেছি ক্ষতিপূরণের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হবো। পুলিশ, জেলা প্রশাসন এবং বরেলি ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করব। 
২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ‘বুলডোজার-ন্যায়’ চালু করা হয়। কোনও ব্যক্তিকে অপরাধী মনে করলেই বিজেপি সরকার বুলডোজার দিয়ে বাড়ি-ঘর, দোকান, হোটেল বা অন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বুলডোজার কার্যত বিজেপি’র প্রতীকে পরিণত হয়েছে। গোদী মিডিয়া যোগীকে ‘বুলডোজার বাবা’ আখ্যা দিয়েছে। আদিত্যনাথের সভায় বিশেষ করে নির্বাচনী সমাবেশগুলিতে বিজেপি নেতা-কর্মীরা বুলডোজার নিয়ে হাজির হয়েছে। এরপরে তা বিজেপি শাসিত মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যে শুরু করে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী সমাবেশ থেকে যোগীর বুলডোজার নীতির সমর্থন করেন। এই ‘বুলডোজার-ন্যায়’ এর অন্যতম লক্ষ্য ছিলেন মুসলিমরা। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার পরে একতরফাভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, অন্য সম্পত্তির উপরে বুলডোজার চালিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলি। পাশাপাশি, উন্নয়নের নামেও কোনও আইনকানুন না মেনে যথেচ্ছ গরিব মানুষের বাড়িঘরে বুলডোজার চালানো হয়েছে। 
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে উত্তর প্রদেশে যোগীর ‘বুলডোজার-রাজ’-এর কী হবে তা নিয়ে এদিন আলোচনা হয়েছে দিনভর। সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে ‘কিছুই হয়নি’ এবং সরকার এ পর্যন্ত যা করেছে সব ‘নিয়ম মোতাবেক’- এমন ভাব করছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন নির্দেশিকা বেঁধে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট যে, ফাঁকফোকর খুঁজে অবাধে বাড়ি-ঘর, সম্পত্তিতে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া সহজ হবে না। এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রঙ্গনাথ পাণ্ডের মতে, যাদের সম্পত্তিতে বিগত বছরগুলিতে অবৈধভাবে বুলডোজার চালানো হয়েছে, এখন তাদের জন্য আদালতে যাওয়ার রাস্তা খুলে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে উত্তর প্রদেশ সরকার রাজ্যে কোনও আইন বা অধ্যাদেশ জারি করে বুলডোজার চালানোর রাস্তা খুলতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও এদিন ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু আইনজীবীদের মতে, সেই সুযোগ নেই। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বরিষ্ঠ আইনজীবী জয়দীপ নারায়ণ মাথুরের মতে, আসলে তো সরকার বুলডোজার দিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল, সন্ত্রস্ত্র করছিল। এবার এই ভয় শেষ হয়ে যাবে। সুপ্রিম কোর্ট তাদের নির্দেশ এবং গাইডলাইন সাংবিধানিক ভিত্তির উপরে দিয়েছে। সেই কারণে রাজ্য সরকার কোনও আইন এনেও এই সিদ্ধান্ত বদল করতে পারবে না। যোগী সরকারের সামনে এমন কোনও আইনও তৈরি করার সুযোগ নেই যাতে কোনও অপরাধী বা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর বৈধ বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে ফেলা যায়। সরকারকে এখন সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন মেনেই কাজ করতে হবে। 
সুপ্রিম কোর্টের বুধবারের রায়ে উত্তর প্রদেশে বুলডোজার-রাজের শিকার মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। এক ধরনের সান্ত্বনাও তাঁদের কাছে এসেছে। সরকার এবং প্রশাসন প্রতিহিংসামূলক মনোভাব থেকে যে অন্যায় করছিল, তার কোনও বিচার নেই বলে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই বিশ্বাসের জায়গাটা ফিরিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বৃহস্পতিবার সংবাদ সংস্থা পিটিআই’র সঙ্গে আলোচনায় এলাহাবাদের জাভেদ মহম্মদ বা বরেলির অবন্তিকার মনোভাবে সেটাই স্পষ্ট হয়েছে। বরেলিতেই গত ২২ জুলাই ১৬ জনের ঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। গৌসগঞ্জ এলাকার শাহী গ্রামে মহরমের তাজিয়া শোভাযাত্রা ঘিরে সংঘর্ষের পরে অভিযুক্তদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে ভেঙে দেওয়া ঘরগুলির বাসিন্দারা রাসিদান, নাফিসা বা সায়রা খাতুন ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন। যোগী সরকারের সময়ে, বিভিন্ন উৎসবের সময়েই সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। সর্বত্রই তা শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। তাদের ভাঙচুর, প্ররোচনার পরে যখন দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে প্রশাসন বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের নামে অভিযোগ দায়ের করেছে। এমনকি আক্রান্তদের নামেও অভিযোগ দায়ের করে দেওয়া হয়েছে। তারপর বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়ি ঘর, দোকান, কারখানা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাঙার আগে ঠিক সেই অভিযুক্তের বাড়িটিকে বেআইনি নির্মাণ বলে দাবি করেছে সরকার। এবং কোনও সময় না দিয়ে রাতারাতি সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। 
এইরকম ঘটনাই ঘটে ব্যবসায়ী জাভেদ মহম্মদের ক্ষেত্রেও। আটালা এলাকায় পাথর ছোঁড়ার ঘটনার পরে তাঁর নামে পাঁচটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। তাঁকেই পাথর ছোঁড়ার ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত বলে জানিয়ে পুলিশ জাভেদের বাড়ি ভাঙাকে বৈধতা দেয়। পুলিশ বাড়ি ভাঙার আগে তাঁকে নোটিস পাঠিয়েছে বলে যে দাবি করে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে জানিয়েছেন জাভেদ। কোনও নোটিস না দিয়ে রাতারাতি ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাঁর বাড়ি। মাথার ছাদ চলে যাওয়ার পরে কী দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে, সে কথাও সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন জাভেদ। সরকার বুলডোজার অ্যাকশান নেওয়ার পরে কোনও আত্মীয়, বন্ধুরাও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কারণ, তাহলে তাদের উপরেও আক্রমণ নেমে আসার আতঙ্ক। ২২ জুন দুই ব্যবসায়ী রাজীব রানা এবং আদিত্য উপাধ্যায়ের লোকেদের মধ্যে  বরেলিতে একটি বিবাদের জেরে গুলি চলে। তার জেরে ২৭ এবং ২৮ জুলাই দুই জনের বাড়িঘর বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। আদিত্য উপাধ্যায়ের মা সাবিত্রী দেবী জানালেন, আমাদের ঘর থেকে জিনিসপত্র পর্যন্ত বের করতে দেওয়া হয়নি, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরেই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে উপাধ্যায়ের রিসর্ট নাকি বেআইনিভাবে নির্মিত। গত অক্টোবরেই সিরাউলিতে একটি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পরে কল্যাণপুর গ্রামে পাঁচটি বাড়িতে বুলডোজার চালানো হয়েছে। উত্তর প্রদেশ সরকার এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলাকালীন সময়ে, শুনানির মধ্যেও বিচারপতিরা সরকারের কড়া সমালোচনা করার পরেও বুলডোজার অভিযান চালিয়েছে যোগী সরকার।

Comments :0

Login to leave a comment