সঞ্জিত দে: ধূপগুড়ি
শারদীয়া এবং দীপাবলির আগে উত্তরবঙ্গের অনেকগুলি চা বাগান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত ১১ ডিসেম্বর বানারহাটে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের দশদিন পরেই বন্ধ হয়েছিল রিয়া বাড়ি চা বাগান। এবার বন্ধ হয়ে গেল বানারহাট দেবপাড়া চা বাগান। সোমবার রাতের অন্ধকারে ১১৪ বছর বয়সী প্রাচীন এই চা বাগান বন্ধ করে সরে পরল মালিকপক্ষ। কর্মহীন হলেন ১১৯৬ জন শ্রমিক। বিনা নোটিশে বাগান ছেড়ে পালিয়ে গেল মালিক কর্তৃপক্ষ, দাবি বাগান শ্রমিকদের। মঙ্গলবার সকালে কাজে যোগ দিতে গিয়ে শ্রমিকদের নজরে আসে বাগানের অফিস বন্ধ। দেখা মেলেনি বাগান কর্তৃপক্ষের কাউকে। এমনকি বাগান ম্যানেজারেরও দেখা মেলেনি। আসেনি অফিস স্টাফরাও। দীর্ঘক্ষণ বাগান গেটে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে খোঁজাখুঁজি করে তাদের সন্ধান না মেলায় তারা বুঝতে পারেন যে বাগান ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছেন বাগান কর্তৃপক্ষ। গত চার বছরে এই নিয়ে চার বার বন্ধ হল দেবপাড়া চা বাগান। কর্মহীন হয়ে পড়লেন প্রায় ১১৯৬ জন শ্রমিক। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে ডুয়ার্সের দেবপাড়া চা বাগানে।
ওই বাগানের কাজ হারানো এক চা শ্রমিক সাবিত্রী পাশোয়ান বলেন, “আমরা ৪৫ দিন কাজ করেছি। তার টাকা দেয়নি। আজ এসে দেখি সব অফিস বন্ধ। কোথাও কেও নেই। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি। বেলা বাড়লে পর সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আসলে ওরা পালিয়ে গিয়েছে। চা বাগান বন্ধ করে চলে গিয়েছে’’।
চা বাগান মজদুর ইউনিয়নের নেতৃত্ব তিলক ছেত্রী বলেন,‘‘সোমবার রাতের অন্ধকারে মালিক পক্ষ পালিয়ে যায়। শ্রমিকদের মুজুরি বকেয়া রেখেছে। পানীয়জলের লাইন কেটেছে। শ্রমিকরা এই বাগানের ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেন। শ্রমিকদের উপর শোষন চালান। প্রতিবাদ করলে সেই শ্রমিককে বসিয়ে দেওয়া হয় নয়তো কাজের বদল ঘটাতো। এই কয়দিন আগেও সহকারী শ্রম কমিশনারের সাথে সভা হয়। সেখানে ম্যানেজার প্রতিশ্রুতি দেয় মুজুরি ঠিকঠাক দেবে। শ্রমিকদের সুবিধা দেখবে। কিন্তু বাগানে ফিরেই স্বমূর্তি ধরেন’’।
চা শ্রমিক সংগঠনের অনান্য নেতৃত্ব বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বার বার ভোটের সময় নানান প্রতিশ্রুতি দেন চা শ্রমিকদের দরদ দেখিয়ে বাস্তবে সে সব মেলে না। রাজ্য সরকার আজ পর্যন্ত একটা বাগান দেখাতে পারবে? যেটা অধিগ্রহণ করে সঠিকভাবে বাগান পরিচালনা করে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগী হয়েছে। আসলে বন্ধ বাগান জমি কারবারিদের হাতে তুলে দিতে ব্যবস্থা করা হচ্ছে’’।
ধূপগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক নির্মল চন্দ্র রায়কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি বিষয়টি জানতাম না, আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম বাগান বন্ধ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি আইন-মন্ত্রীর সাথে কথা বলব। বিনা নোটিশে বাগান কর্তৃপক্ষ কেন চলে গেল তারও খোঁজ খবর নেব’’।"
তালা পড়ছে উত্তরবঙ্গের একের পর এক চা বাগানে। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে শ্রমিকদের। একদিকে যখন দু’মুঠো চাল জোগাড়ের দুশ্চিন্তা, আরেকদিকে তখন চিন্তা স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েও। খিদের জ্বালায় জ্বলছেন বাগানের শ্রমিকেরা। রুজিরুটির টানে কাজের সন্ধানে বন্ধ চা বাগানের অনেক শ্রমিক পরিযায়ী হয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য ও পানীয় জলের মতো জরুরি পরিষেবাও বন্ধ বাগানে মিলছে না। খেতে না পেয়ে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে, ততই বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। কর্মহারা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বাগানের বিরাট অংশের শ্রমিকরা। উপায় না পেয়ে কাজের সন্ধানে বন্ধ চা বাগিচা শ্রমিকেরা পরিযায়ী হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। বন্ধ বাগানের সুযোগ নিয়ে নারী পাচার চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্ষোভের ফুঁসছেন বন্ধ বাগানের শ্রমিকেরা। একাধিকবার বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত করেছেন চা শ্রমিকেরা। স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। রাজ্যে নতুন কলকারখানা তো হচ্ছেই না, চালু শিল্পও ক্রমশ ধ্বংসের পথে।
চা শ্রমিক নেতা জানালেন, দুই সরকার মিলে চা শ্রমিকদের অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে মুনাফা লুটের নেশায় বাগানগুলিকে ছিবড়ে করে দিচ্ছে মালিকরা। শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। অবিলম্বে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে উত্তরবঙ্গের চা শিল্প বেঁচে থাকে।
Comments :0