স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়
এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ববিতা দাস, বাবা পেশায় ফুলবিক্রেতা। মা গৃহ পরিচারিকা।
সূর্য ওঠার আগে থেকে দিন যাপনের লড়াইয়ের শুরু, রাত পোহালে পরীক্ষা, পরীক্ষার পরই কলেজে ভর্তি, সঙ্গে গাদাগুচ্ছের টাকার জোগার। ববিতার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, আখেরে হবে কী? পড়াশোনা যত ভালই হোক গন্তব্য তো একটিই, কলকতার গান্ধীর মূর্তির পাদদেশ।
চলতে থাকে নার্সিং ট্রেনিং থেকে বিউটিশিয়ানের কোর্সের খোঁজখবর। বিদ্যাসাগার কলেজের স্নাতক স্তরের ছাত্রী প্রীতি দে। ছোটবেলা থেকেই বাবা নিরুদ্দেশ। মায়ের অল্প অল্প রোজগারে বেড়ে ওঠা। অতি কষ্টে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে চতুর্থ সেমেস্টারের পরীক্ষা নিয়ে হাবুডুবু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ধোঁয়াশা। আর জটের গেরোয় পড়ে একটিই প্রশ্ন, এবার কী হবে।
সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসতে দরকার ধৈর্য। সাথে অর্থ। তারপরও সাফল্য অনিশ্চিত। কিন্তু সফল হলেও চাকরি জুটবে এমন কোনও কথা নেই এ রাজ্যে। মায়ের সারাদিনের খাটুনি কিছুটা কমাতে টিউশনি শুরু করেছে প্রীতি। তাতেও সেমেস্টারের পড়াশোনা, সারাদিনের সংসার ঠেলা, কলেজ টিউশনি সামলে সামনের দিনের কথা ভাবতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে কুড়ি বছরের প্রীতি। চোখের কোণদুটো চিকচিক করে ওঠে।
রায়গঞ্জ থেকে কলকাতায় পড়তে আসা ইংরেজি বিভাগের স্নাতক ছাত্রী রোমা পালচৌধুরী হস্টেলে থেকে পড়া শেষ করেছে। সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখা অন্যায়, অহেতুক সময় নষ্ট। আর সময় নষ্ট করা যাবে না, রোমা অন্তত এমনটাই ভাবে। খুব ইচ্ছে কলকাতায় থেকে যাওয়ার, কলকাতাকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছে। বেসরিকারি সংস্থায় হন্যে হয়ে ইন্টারভিু দিয়ে গিয়েছে, কোনও জায়গা থেকেই সদর্থক সাড়া আসেনি।
কার্যত দিশেহারা অবস্থা তাঁর। অর্থ রোজগার করতে না পারলে সামনের দিনগুলি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। ইদানিং বন্ধুর বাড়িতে উঠেছে। পনেরো দিন সময় ঠিক করে রেখেছে। কিছু না হলে স্বপ্নের ফানুসকে বগলদাবা করে পাততাড়ি গোটাতে হবে।
রেশমি সেনগুপ্ত, মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী। বাবার চাকরি টলোমলো। করোনাকালে চাকরি চলে যাওয়ার পর কোনও শক্তপোক্ত রোজগার নেই, মা সেলাই করেন। এখন একটাই উদ্দেশ্য, কাজ খোঁজা, রোজগার করা। পড়াশোনা চালাতে চালাতে সম্প্রতি একটি শপিং মলের কাউন্টার সেলিংয়ের কাজ পেয়েছে। সারা দিনে প্রায় বারো ঘন্টা দাঁড়ানো, খুব কম সময় বসার সুযোগ পায়। এই কাজ করে স্নাতক হওয়া অত্যন্ত কঠিন, সে বুঝতে পারে। কিন্তু অপারগ। সংসারের বোঝা আর নিজের লেখাপড়া, দাঁড়িপাল্লার ভার সব সময় একদিকেই হেলে থাকে। ইচ্ছে ছিল স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। সেই স্বপ্নে জল ঢেলেছে পরিস্থিতি, সময় আর বর্তমান চারপাশ।
এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষায় চার লক্ষ পড়ুয়া সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ছিটকে গেল। ২০২২’এ ১০ লক্ষ ৯৮ হাজার ৭৭৫ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল। এবার সেখানে ৬ লক্ষ ৯৮ হাজার ৬২১ জন। পরিসংখ্যান অত্যন্ত চিন্তার, ভয়ানকও।
যোগ্য সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা ধর্নামঞ্চে অর্থাৎ গান্ধীমূর্তির নিচে ৭০০ দিন পার করে বসে রয়েছেন। অতিমারীর সময়ে পরীক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন পদ্ধতির মান একেবারে নিচের স্তরের। তাতে ছাত্রছাত্রীদের নিষ্ঠা, নিয়ম, অধ্যবসায় কয়েক হাত নিচে চলে গিয়েছে।
ছাত্রছাত্রীদের দোষ কী! পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তো চোর, ডাকাত, লুটেরাদের হাতে চলে গিয়েছে। লুটেরাদের সামনে ছাত্রছাত্রীরা অসহায়। এই চার লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পরিযায়ীর ঢল, সময়ের আগে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েরা রয়েছে। অনলাইন পড়াশোনা তাদের পরীক্ষার জন্য অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। এ সব বাদ দিলেও, ভবিতব্যের দিকে না তাকিয়েই কি তারা শিক্ষার আঙিনা থেকে বিদায় নিল?
প্রতিদিন যখন চাকরি বিক্রির দর কয়েক লক্ষ টাকায় উঠছে, সংবাদের শিরোনামে আসছে, চলে যাচ্ছে হতবদল হতে হতে ওপরতলায়, সেখানে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা শুরুতেই হতাশ হয়ে পড়ছে। গোটা সমাজব্যবস্থার জন্য নেতিবাচক এই ছবি।
সমাজের মান এভাবেই নামতে থাকবে এমন চলতে থাকলে। আর সস্তার রাজনীতি বেছে নিলে এমন দিন অবধারিত। ঘুরে দাঁড়ানো দরকার এখনই। দুর্নীতি-দুষ্কৃতীর গোটা চক্র বদলে ফেলতে হবে। না হলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্রমশ বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
Comments :0